শেখ হাসিনার পতন হজম করতে না পেরে ভারত অপপ্রচারে মেতেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার পতনে তাদের অন্তরে অনল দহন চলছে। অপপ্রচারে মেতেছে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি ও তার সহযোগীরা। ভারতের এ আচরণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে হুমকি বলে অভিযোগ করেছেন।
আজ রোববার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে রুহুল কবির রিজভী এসব কথা বলেন।
বিএনপি নেতা রিজভী বলেন, ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মুখে গণতন্ত্রের ঘাতক শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশে স্বস্তি-শান্তির অভাবনীয় স্বর্ণদ্বার উন্মোচিত হয়েছে। দেশের চারদিকে গণতন্ত্র উত্তরণের সম্ভাবনায় জন–উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছে। মানুষের কাঁধ থেকে দেড় দশকের জগদ্দল পাথর অপসারণ হয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই যখন একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন, তখন বাংলাদেশের দেড় দশকের সন্ত্রাসী মাফিয়া লীগের রক্তাক্ত তাণ্ডবে চুপ থাকা ভারত সরকারের সর্বস্ব হারানোর বেদনাবিদ্ধ অস্থিরতা আর অস্বস্তি বিস্ময়কর রকমের প্রকট হয়ে উঠেছে। অতিমাত্রায় দাদাগিরির কারণে ভারতের সঙ্গে তার প্রত্যেক প্রতিবেশীর সম্পর্ক তলানিতে। শুধু হাসিনার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল বাংলাদেশের ওপর। ভারত বাংলাদেশকে ‘আশ্রিত রাজ্যের’ মতো বিবেচনা করত। সেই ‘রাজ্য’ হাত ফসকে গেছে। বিগত ১৫ বছর হাসিনাকে সামনে রেখে ভারত বাংলাদেশকে কার্যত দখল করে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
রিজভী বলেন, এখন বাংলাদেশকে আবার কীভাবে তাদের করতলে নেওয়া যায়, সেই লক্ষ্যেই তারা নীলনকশা করছে। ভারত সরকার মনে করে, বাংলাদেশকে ‘অষ্টম সিস্টার’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে তাদের সেভেন সিস্টার্স নিরাপদ থাকবে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ও পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই মোদি ও তাঁর গদি মিডিয়া বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারা চরম হতাশা-আহাজারিতে নিমজ্জিত। একজন স্বৈরাচারের পতন নিয়ে কোনো দেশের এমন আহাজারি বিশ্বে বিরল। ভারতের কিছু গণমাধ্যমে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বানোয়াট গল্প প্রচার ও প্রোপাগান্ডা চালিয়ে সাম্প্রদায়িক উসকানি দিচ্ছে। ভারতের সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠী ও হাসিনার যৌথ ইন্ধনে সে দেশের কিছু উগ্র হিন্দুত্ববাদী গণমাধ্যম এমন অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের বর্তমান বয়ান মিথ্যার ধোঁয়াজালে ঘেরা। এদের মধ্যে মানবিক নৈতিকতার ছিটেফোঁটাও নেই। এ কারণে তারা বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব ইতিহাস–ঐতিহ্য ও স্বাভাবিক বিকাশে বিশ্বাসী দেশের জনগণ ও জাতীয় নেতাদের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করে।
রিজভী বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভঙ্গের কোনো কারণ ঘটেনি। কিন্তু পাশের দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ব্যাপক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করতে ভারত উঠেপড়ে লেগেছে। বাংলাদেশকে লাঞ্ছিত করতে, দুর্দশায় ফেলতে, অবমাননা করতে চলছে অতিকথন আর অপপ্রচারের বিরতিহীন ধারাভাষ্য। ভারতের যাবতীয় ভয়, হুমকি ও দুর্বিপাকের মধ্যেও বাংলাদেশিরা মৃত্যুঞ্জয়ী সংকল্পে সব চক্রান্তকে প্রতিহত করবে।
বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, ‘প্রতিদিন বাংলাদেশে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারত সরকার ও উগ্রবাদী বিজেপির নেতারা বক্তব্য-বিবৃতি, হুংকার এবং বায়বীয় অভিযোগ করে চলেছেন। কলকাতায় আমাদের উপহাইকমিশনে উগ্রবাদী হিন্দুরা আক্রমণ চালিয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে ভারতীয় গোয়েন্দারা আওয়ামী লীগ ও বিশেষ একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠীকে কীভাবে ব্যবহার করছে, সেই পরিকল্পনার ছক প্রকাশ্যে এসেছে। তাদের যে কোনো ভিত্তি নেই, তার প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি ভয়েস অব আমেরিকার (ভিওএ) করা একটি জরিপে। জরিপে অংশ নেওয়া ৬৪ দশমিক ১ শতাংশ মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে।’
রিজভী বলেন, বরং ভারতে কীভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে, তা নিয়ে স্পষ্টভাবে প্রশ্ন তোলা যায়। ভারতে প্রতিনিয়ত মুসলমানরা নিপীড়ন-নির্যাতন, এমনকি খুনের শিকার হচ্ছেন। বাড়িঘর ও স্থাপনা বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। শুধু মুসলমানই নয়, দেশটির খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। আসামে খ্রিষ্টিয়ান ফোরাম বলেছে, আসামে কয়েক বছর ধরে সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ধারাবাহিকভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছে। মণিপুরে হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের উপাসনালয় ধ্বংস করা হয়েছে।
একটি প্রতিবেদনের উল্লেখ করে রিজভী বলেন, ভারতে ২৫০টির বেশি গির্জা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ২০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং ৬০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ভারতের অহিন্দু জনগোষ্ঠী মুসলিম, খ্রিষ্টান ও শিখ সম্প্রদায় যৌথভাবে সাম্প্রদায়িকতার হুমকির মুখে। বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার নীতি হলো—সহিংসতা, বৈষম্য, সংখ্যালঘুদের ওপর ধর্মীয় নিপীড়নের মাধ্যমে ভীতি ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা।
ভারত দ্বিচারিতা করছে উল্লেখ করে বিএনপি নেতা বলেন, হিসাব করলে দেখা যাবে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে ভারতে। তারাই আবার বড় গলায় বলছে, বাংলাদেশে নাকি সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ভারত নিজের দেশের যেখানে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে তাদের এত মাথাব্যথা কেন?
রিজভী বলেন, বাংলাদেশে বিতর্কিত এক ধর্মীয় নেতা চন্দন কুমার ধর ওরফে চিম্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারী হিন্দু জঙ্গিরা তরুণ আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে আইন অমান্য করেছে, আদালত অবমাননা করেছে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। ভারত সরকার এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেনি। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে যে হিন্দুদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর, জমিজমা দখল হয়েছে, তা নিয়ে ভারতকে তো কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। এমনকি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বিএনপির যে লাখ লাখ নেতা–কর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর স্টিমরোলার চালিয়ে গুম, খুন, অপহরণ, জেল–জুলুম করেছে, অরাজনৈতিক বিরোধী মতকে দমন করেছে, তা নিয়েও টুঁ শব্দ করেনি। পিলখানায় হত্যাযজ্ঞ, শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে গণহত্যা, তিনটি ভোটারবিহীন সংসদ নির্বাচনসহ কোনো অপকর্মের প্রতিবাদ ভারত করেনি। বরং এসবের বৈধতা ও সমর্থন দিয়েছে।
রিজভী বলেন, ভারত সব বাংলাদেশির স্বার্থের কথা না বলে সব সময় শুধু একটি সম্প্রদায়ের স্বার্থে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কথা বলে। ভারতের এ আচরণ ভারতকে সর্বজনীন না করে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের পক্ষাবলম্বী করেছে। ভারতের এসব আচরণ এ দেশের সাধারণ মানুষ মেনে নেয়নি। এ দেশের মানুষ কঠিন সময়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে জানে। প্রতিরোধের দুর্ভেদ্য দেয়ালও প্রতিষ্ঠা গড়ে তুলতে পারে। এ দেশের হিন্দুদেরও বৃহদাংশ ভারতের এই নীতি সমর্থন করে না। আজ এ বাস্তবতা ভারতকে বুঝতে হবে। অসূয়া শক্তির কখনো জয় হতে পারে না।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কেউ কেউ তাঁদের বক্তব্য-বিবৃতিতে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে বিএনপিকে প্রতিবন্ধক বলে প্রচার করছেন, যা সঠিক নয়। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা, না–করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সরকারের। বিএনপির ওপর দায় চাপানো দুঃখজনক। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার যখন জামায়াত নিষিদ্ধ করেছিল, তখন আমরা প্রতিবাদ করেছি।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
prothom alo