শতকের ঘরে লাল–সবুজের পতাকাবাহী জাহাজ

এমভি মেঘনা সেঞ্চুরি

অস্ট্রেলিয়ার বন্দরে নোঙর করে রাখা ‘এমভি নিউ চাম্প’ জাহাজে শেষবারের মতো উড়ছে লাইবেরিয়ার পতাকা। আর কিছুদিন পরই উড়বে লাল-সবুজের পতাকা। কারণ, জাহাজটি কিনে নিয়েছে দেশীয় মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ বা এমজিআই। নিবন্ধনের জন্য চট্টগ্রামের নৌবাণিজ্য অফিসে আবেদনও করেছে গ্রুপটি।

এই জাহাজ দিয়ে শতকের ঘরে উন্নীত হচ্ছে সমুদ্রগামী দেশীয় জাহাজের বহর। দেশীয় বহরে সমুদ্রগামী জাহাজের শতক উপলক্ষে এমজিআই ‘এমভি নিউ চাম্প’ জাহাজটির নতুন নাম দিয়েছে ‘এমভি মেঘনা সেঞ্চুরি’। জাহাজটি দিয়ে এমজিআইয়ের বহরে সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা দাঁড়াল ২৪।

এমজিআই জাহাজটি কিনেছে ৩ কোটি ৫৩ লাখ ডলারে। ডলারপ্রতি ১১৭ টাকা দরে বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়ায় ৪১৩ কোটি টাকা। এর আগে দেশীয় বহরের ৯৯তম জাহাজটিও তাদের। ৯৯তম জাহাজটির নাম প্রস্তাব করা হয়েছে এমভি মেঘনা পাইওনিয়ার। এই দুই জাহাজে গ্রুপটির বিনিয়োগ প্রায় ৭ কোটি ডলার বা ৮০০ কোটি টাকা। এমভি মেঘনা পাইওনিয়ার এ মাসে এবং মেঘনা সেঞ্চুরি জাহাজটি আগামী মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে মেঘনার হাতে তুলে দেবে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। হস্তান্তরের পরই বিদেশি নাবিক নামিয়ে জাহাজ দুটিতে তোলা হবে দেশীয় ৪২ জন নাবিক।

জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনা এমন খাত, যেখানে বিনিয়োগের পরই বিদেশি পণ্য পরিবহন বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায়। আবার দেশীয় পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যায়। একই সঙ্গে দক্ষ পেশাজীবীর কর্মসংস্থানও করা যায়। সুফল আছে বলেই এই খাতে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছি।’

পাঁচ বছরে বিনিয়োগ বিলিয়ন ডলার

উদ্যোক্তা ও কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, দেশীয় বহরে সচল থাকা ১০০টি (নিবন্ধনের অপেক্ষায় থাকা জাহাজসহ) জাহাজ কেনায় বিনিয়োগের পরিমাণ ১৪৪ কোটি ডলার (প্রতি ডলার ১১৭ টাকা হিসাবে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা)। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরে যুক্ত হওয়া ৭১টি জাহাজে বিনিয়োগ হয়েছে ১১৪ কোটি ডলার। মূলত দুটি গ্রুপ দেশীয় বহরকে এগিয়ে নিয়েছে। গ্রুপ দুটি হলো এমজিআই ও কেএসআরএম। নিবন্ধনের অপেক্ষায় থাকা নতুন জাহাজসহ দুই গ্রুপের প্রতিটির বহরে রয়েছে ২৪টি করে জাহাজ। অর্থাৎ দেশীয় বহরের ৪৮ শতাংশই এই দুই গ্রুপের হাতে।

নৌবাণিজ্য অফিস ও চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, মেঘনার বহরে থাকা সাড়ে ১৩ লাখ টন পণ্য পরিবহনক্ষমতার ২৪টি জাহাজে বিনিয়োগ হয়েছে ৫০ কোটি ডলার। কেএসআরএম গ্রুপের বহরে থাকা ২৪টি জাহাজে বিনিয়োগ প্রায় ২৯ কোটি ডলার। গ্রুপটির বহরে থাকা জাহাজের পণ্য পরিবহনক্ষমতা প্রায় ১৩ লাখ টন।

আকিজ শিপিং লিমিটেডের বহরে থাকা ১০টি জাহাজে বিনিয়োগ প্রায় ৯ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে এখন ১৮টি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ রয়েছে এই খাতে। বেশির ভাগ বিনিয়োগ গত সাড়ে পাঁচ বছরে।

সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনায় নানা ঝুঁকির পরও বিনিয়োগ থেমে থাকেনি দেশীয় উদ্যোক্তাদের। দেশীয় পতাকাবাহী ‘এমভি আবদুল্লাহ’ কিংবা ‘এমভি জাহান মণি’র কথাই ধরা যাক। কেএসআরএম গ্রুপের দুটি জাহাজই সোমালিয়ার দস্যুরা ছিনতাই করেছিল। মুক্তিপণ দিয়ে ২০১১ সালে এমভি জাহান মণি এবং গত এপ্রিলে এমভি আবদুল্লাহ ছাড়িয়ে এনেছে গ্রুপটি। এরপরও নতুন বিনিয়োগে নিজেদের বহর বাড়িয়েছে কেএসআরএম। সম্প্রতি এমভি জাহান-১ নামে নতুন একটি জাহাজে বিনিয়োগ করেছে গ্রুপটি।

কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত প্রথম আলোকে বলেন, সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে সরকারের নীতি এখন অনেক বেশি উদ্যোক্তাবান্ধব। এ কারণেই কেএসআরএম গ্রুপ ব্যবসা সম্প্রসারণের প্রয়োজনে নতুন নতুন জাহাজ বহরে যুক্ত করছে।

উদ্যোক্তারা জানান, ১৯৭৮ সালে অ্যাটলাস শিপিং লাইনস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা সানাউল্লাহ চৌধুরীর হাত ধরে বেসরকারি খাতে এই খাতে বিনিয়োগ শুরুর পর উত্থান-পতনেই আটকে ছিল দীর্ঘ সময়। এ অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে ২০১৮ সাল থেকে। সরকারি নীতিসহায়তা বাড়ার পর উদ্যোক্তারাও বিনিয়োগ শুরু করেন, যা এখনো অব্যাহত আছে। বাল্ক ও জ্বালানি তেল পরিবহনের জাহাজের পাশাপাশি দেশীয় বহরে এলপিজি, কনটেইনার কিংবা ভোজ্যতেল পরিবহনের জাহাজ যুক্ত হয়েছে।

আসছে নতুন বিনিয়োগ

টিকে গ্রুপ বছরে ৮ লাখ টনের মতো ভোজ্যতেল আমদানি করছে। নিজেদের আমদানি পণ্য পরিবহনে ব্যয় কমাতে এবার গ্রুপটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান সামুদা শিপিং লিমিটেড সমুদ্রগামী জাহাজে প্রথমবারের মতো নতুন বিনিয়োগ করেছে। গত মাসে প্রতিষ্ঠানটি ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার (১৫৭ কোটি টাকা) ব্যয়ে ‘এমটি সামুদা’ নামে তেল পরিবহনকারী ট্যাংকার কিনেছে। ট্যাংকারটি ২৪ হাজার টন ভোজ্যতেল পরিবহনে সক্ষম।

সামুদা শিপিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও টিকে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে সরকারের নীতি একটানা কয়েক বছরে ধরে বিনিয়োগবান্ধব হয়েছে। এ জন্যই এ খাতে বিনিয়োগ করেছি। অভিজ্ঞতা ভালো হলে এই খাতে আরও বিনিয়োগ করতে চাই।’

নতুন বিনিয়োগের মতো নতুন জাহাজ পরিচালনায় ঝুঁকছেন উদ্যোক্তারা। যেমন, মেঘনা গ্রুপ গত বছর নতুন তৈরি চারটি জাহাজ পানিতে ভাসিয়েছে। এমজিএলের একটি জাহাজ রয়েছে। এই গ্রুপের নতুন দুটি জাহাজ যুক্ত হবে ২০২৬ সালে। নতুন দুই জাহাজে গ্রুপটির বিনিয়োগ প্রায় ১১ কোটি ডলার।

সম্ভাবনা কাজে লাগানো দরকার

সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দুটি তথ্য দেওয়া যাক। গত অর্থবছরে (২২-২৩) সমুদ্রপথে পণ্য আমদানি হয়েছে ১১ কোটি ৪ লাখ টন। এ সময় পণ্য পরিবহন ভাড়া বাবদ ব্যয় হয়েছে ৪৪৪ কোটি ডলার। এর মানে হলো, দেশে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হয়, তার একাংশ যদি দেশীয় জাহাজে পরিবহন করা যায়, তাহলে বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব।

দেশীয় বহরে থাকা জাহাজগুলো এখনই বিদেশি মুদ্রা সাশ্রয় করছে। আবার পণ্য পরিবহন করে ডলার আয় করছে। কী পরিমাণ ডলার আয় করছে, তা পাওয়া যায় রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন করে আয় হয়েছে ৬৮ কোটি ডলার। এই রপ্তানি আয়ের নেতৃত্বে রয়েছে দেশীয় জাহাজগুলো।

সচরাচর শিল্পকারখানায় বিনিয়োগের পর পণ্য উৎপাদনের জন্য কারখানা প্রস্তুত করতে কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়। সমুদ্রগামী জাহাজে বিনিয়োগের পরপরই আয় আসতে শুরু করে। আবার জাহাজ সংগ্রহের পরপরই কর্মসংস্থান শুরু হয় এ খাতে। ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণেরও বড় সুযোগ করে দিচ্ছে দেশীয় জাহাজের বহর।

তবে জাহাজ নিবন্ধনকারী সংস্থা নৌবাণিজ্য অফিসের মুখ্য কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ আরও বড় সম্ভাবনার কথা জানালেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি নীতিসহায়তা বাড়ায় সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনায় বেসরকারি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন, এটি খুবই ইতিবাচক। তবে সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনা শিল্পে ব্যয়ের খাত অনেক। কোম্পানিগুলো নিজস্ব জাহাজের পাশাপাশি সমুদ্রগামী জাহাজ ভাড়া নিয়ে পরিচালনা করলে আয়ের বড় সুযোগ তৈরি হবে। আবার রক্ষণাবেক্ষণ, রসদ সরবরাহ-জাহাজ পরিচালনায় ব্যয়ের এমন অনেক খাতে যদি ব্যবসার সুযোগ তৈরি করা যায়, তাহলে বিনিয়োগের সুফল আরও বাড়বে।

prothom alo