- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ০৪ নভেম্বর ২০২০
ন্যায় একটি নীতিবোধক শব্দ। আমরা প্রায়ই ন্যায়-অন্যায়ের কথা বলি। ন্যায় দ্বারা ভালো কিছু বুঝি। অন্যায় দ্বারা খারাপ কিছু। ন্যায়ের চিরায়ত সংজ্ঞা আছে। সব দেশে সব কালে কিছু কিছু বিষয়কে ন্যায় বলা হয়। অসততা, অনাচার, অপরাধ ও অত্যাচারকে আমরা অন্যায় বলি। এরপরও দেশাচার ও লোকাচারে ন্যায়-অন্যায়ের ফারাক আছে। লিও টলস্টয় বলেন, ‘দেয়ার ইজ নাথিং গুড অর ব্যাড ইন দিস ওয়ার্ল্ড, থিংকিং মেইক ইট সো।’ মানুষের মনোভাবকে গুরুত্ব দিয়েছেন টলস্টয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশ-কাল-পাত্রভেদে এমনটি হতেই পারে। এক দেশের আচার, অন্য দেশে অনাচার বলে কথিত হতে পারে।
ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব চলে এসেছে চিরকাল। শাসক যা ন্যায় মনে করে, শাসিত তা মনে না-ও করতে পারে। এভাবে ‘অন্যায়’ ন্যায় হয়ে যেতে পারে। ‘ন্যায়’ অন্যায় হিসাবে প্রতিভাত হতে পারে। এটি ব্যাখ্যা এবং বাস্তবতার বিতর্ক। মানুষ যখন বলে ‘ডিজঅর্ডার বিকামস দ্য অর্ডার অব দ্য ডে’-তখন সে চিরায়ত সংজ্ঞার বিপরীতে কথা বলে।
মনীষী প্লেটো বিষয়টিকে তত্ত্বকথার আবরণ দিয়েছেন। তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’-এর মূল বিষয় হচ্ছে ন্যায়ের সন্ধান। তিনি গ্রন্থটির দ্বিতীয় শিরোনাম দিয়েছেন- ট্রিটিস কনসার্নিং জাস্টিস : ন্যায় সম্পর্কিত আলোচনা। ব্যক্তি এবং সমষ্টি তথা রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়ের কোনো রকম হেরফের হবে না। বরং ন্যায়ের ধারণা এক ও অনন্য। সর্বব্যাপী এটাই রিপাবলিকের শিক্ষা। কিন্তু এই মূল সিদ্ধান্তে আসতে বিষয়টির নানাবিধ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন। সরাসরি কোনো প্রশ্নের সমাধান দেয়া প্লেটোর ধর্ম নয়। সক্রেটিসের জবানিতে সংলাপের পর সংলাপ- পরম্পরার মাধ্যমে তিনি পৌঁছেছেন যৌক্তিক সিদ্ধান্তে। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি প্রমাণ করতে চাইছেন ‘ন্যায় হচ্ছে শক্তিমানের স্বার্থ’। তার মতে, ন্যায় ও অন্যায় ইত্যাকার শব্দগুলো শাসকের তৈরি। তাদের জন্য যা স্বার্থবহ তাকেই তারা ন্যায় বলে শাসিতের ওপর চাপিয়ে দেয়। শাসিতের যে কাজ তাদের স্বার্থের পরিপন্থী তাকে শাসকরা অন্যায় বলে। কাজেই ন্যায়-অন্যায় মানুষেরই তৈরি। আরো সরল ভাষায় বলা যায়, শক্তিমানের তৈরি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তি নিরপেক্ষ, রাষ্ট্র নিরপেক্ষ বলে আমরা যা বুঝি তা শাসকের স্বার্থ উৎসারিত। ন্যায় হচ্ছে দুর্বলকে শোষণ করার জন্য শক্তিমানের কৌশল কিংবা শক্তিমানকে প্রতিরোধ করার জন্য দুর্বলের জোট। ন্যায়ের এই আপাত সংজ্ঞাটা একটি কূটাভাস। প্লেটোর মূল বক্তব্য এটি নয়। আজকের বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তত্ত্বটিকে লাগসই মনে হয়েছে- তাই এা অবতারণা।
বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে তা শক্তিমানের স্বার্থের পরিপূরক। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সম্মতির যে অনিবার্য প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে তা এই সময়ে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সংবিধান, গণতন্ত্র ও নির্বাচনের মতো মহৎ শব্দাবলির আড়ালে ‘কোয়ার্সিভ গভর্ন্যান্স’ বা শক্তি প্রয়োগের শাসন চলছে। শক্তি মদমত্ততা এতটাই নিকৃষ্ট পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ভিন্নমতকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে অভিহিত করা হচ্ছে। মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার অস্বীকার করা হচ্ছে। পুলিশ মানববন্ধনে হামলা করে, পেটোয়াবাহিনী মিছিল তছনছ করে দেয়। একজন প্রতিবাদী যুবককে গ্রেফতারের পাঁয়তারা চলে। জাতীয় নির্বাচন থেকে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন পর্যন্ত দলীয় একনায়কতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে। রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত দুর্নীতি ও দুঃশাসনের ফলে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। উন্নয়নের গণতন্ত্রের নামে পেশীতন্ত্র কায়েম হয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান- শক্তি প্রয়োগে বিপর্যস্ত হয়েছে। এভাবে ন্যায় পরিত্যক্ত হয়েছে। অন্যায় নীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে। যারা শক্তিমান, শক্তির মাধ্যমে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে শুধু তাদেরই প্রভুত্ব কায়েম হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, জনগণই ক্ষমতার উৎস। এখন জনগণের পরিবর্তে শক্তি প্রয়োগ একমাত্র উপায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বিগত দু-এক মাসে দু-একটি ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে, আপামর জনসাধারণ নয়, আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন শুধু শক্তি প্রদর্শনকারী ব্যক্তি ও বাহিনীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কক্সবাজারে একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজরকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড ঘটায় পুলিশের নিতান্তই একজন নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা। পুলিশ যখন তখন বেপরোয়া আচরণ করছে। বন্দুকযুদ্ধের নামে মানুষ হত্যা করছে। কখনো কারো টুঁ শব্দটি করার জো নেই। কিন্তু যখন সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতা এলো তখন শাসকগোষ্ঠী নড়েচড়ে বসল। সংবাদপত্রের ভাষ্য মোতাবেক সরকারপ্রধান নিজে হস্তক্ষেপ করলেন। সেনাবাহিনী ও পুলিশবাহিনী প্রধান ছুটে গেলেন অকুস্থলে। গ্রেফতার করা হলো অপরাধীকে। অথচ এর আগে নিহত মেজর সিনহা ও তার সঙ্গীদের উল্টো মামলা দিয়ে ‘ডাকাত’ প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছিল পুলিশ। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বললেন, ‘আমরা কোনো ইস্যুকে ষড়যন্ত্রের বাহন হতে দেবো না।’ অথচ একই জায়গায় পুলিশ একই স্টাইলে অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। তখন পুলিশকে বরং আইনি রক্ষাকবচ দেয়া হয়েছে। প্রতিদিন সংবাদপত্রে পুলিশ নির্যাতনে সাধারণ মানুষের মৃত্যুর খবর আসছে। সর্বশেষ সিলেটের ঘটনায় পুলিশের এএসআই আকবরকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি। বরং অভিযোগ, পালিয়ে যেতে দেয়া হয়েছে। এর পরের ঘটনাটি পুরান ঢাকার সংসদ সদস্য হাজী সেলিমপুত্র এরফান সেলিমের।
হাজী সেলিমপুত্র রাজপথে যে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেন তা কেবল শক্তিমানের পক্ষেই সম্ভব। শক্তিমানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি ভদ্রতা-সভ্যতা, সৌজন্য-সংস্কৃতি ও আইন-কানুন রীতি-নীতির কোনোই তোয়াক্কা করেন না। তিনি আইনের ঊর্ধ্বে বিবেচনা করেন নিজেকে। সবাই তাকে সালাম ঠুকবে। জি হুজুর করে কথা বলবে। দুর্ভাগ্যবশত সেলিমপুত্রের গাড়ি যাকে ধাক্কা দিয়েছিল তিনিও ছিলেন ক্ষমতার আরেক বরপুত্র। নৌবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। তার পেশা তাকে নিজেকে সম্মান করতে শিখিয়েছে। তাই তিনি সাহস পেয়েছেন জিজ্ঞাসা করতে, গাড়ি ধাক্কা দিলেন কেন? কেউ এ রাজপুত্রকে এ কথা জিজ্ঞাসা করার স্পর্ধা রাখে না। সুতরাং তিনি দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছেন। নৌ-ক্যাপ্টেনের দাঁত ভেঙে দিয়েছেন। একজন গোবেচারা পাবলিকের মতো লেজ গুটিয়ে চলে যাননি ক্যাপ্টেন। ততক্ষণে অবশ্য পাবলিক জড়ো হয়েছে। ভিডিও হয়েছে। আজকাল ভিডিও হওয়াটাও রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। মামলা হয়েছে। সাধারণ ঘটনা হলে হয়তো পুলিশ মামলাই নিতো না। কিন্তু বাহিনী বলে কথা! কর্তব্যরত কর্মকর্তা বুদ্ধিমানের মতোই কাজ করলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মানে অবশেষে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব। স্তরক্রম ভেদ করে খবরটি যথাস্থানে পৌঁছল। শাসকদলের একজন দাপুটে সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রী পর্যায় পর্যন্ত কুলোয় না বলেই জনগণের ধারণা। সুতরাং যা হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনাতেই তা হয়েছে। এটি বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ ও উদাহরণ ইতঃপূর্বে রয়েছে। জনপ্রিয় কলামিস্ট আসিফ নজরুল প্রশ্ন করেছেন, ‘সড়কে ধাক্কাটা আমি খেলে কী হতো?’ উত্তরটা তিনিই দিয়েছেন- ‘মার খেয়ে আমার অবস্থা হতো শোচনীয়। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরতাম ক্ষুণ্ণ মনে। পরে হয়তো থানায়ও যেতাম। গেলে দেখতাম মামলা নিতে আগ্রহী নয় থানা। কিংবা দেখতাম উল্টো আমার নামে মামলা হয়েছে, থানায় গাড়িও আটকে রাখা হয়েছে শুধু আমারটা। ভোগান্তি এখানে শেষ হতো না। পরদিন পত্রিকায় দেখতাম সেই নেতার জনসংযোগ কর্মকর্তা দাবি করেছেন, আমি উল্টো মারতে গিয়েছিলাম তাদের। তারা আত্মরক্ষা করতে গিয়েছিল এবং নিজে নিজে হুমড়ি খেয়ে আমার দাঁত ভেঙে গিয়েছিল’। আসিফ নজরুল যথার্থই বলেছেন। এর উদাহরণ খুঁজতে পাঠককে বেশি দূরে যেতে হবে না। আশপাশে তাকালে অনেক ঘটনা দেখবেন। আর একটু যোগ করি, যেহেতু তিনি একজন স্বনামধন্য শিক্ষক, শিক্ষক সমিতি যদি সরকারের করতলগত না হয় তাহলে হয়তো মৃদু বিবৃতি যেত পত্রিকায়। আমার মতো ছাপোষা কলামিস্টরা একটু কাইকুই হয়তো করত। সময় শেষে সব ঠিক। সুতরাং সাধারণ মানুষের বেহাল অবস্থা সহজেই অনুমেয়। দুই শক্তিমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হয়েছে বলেই অতটুকু হয়েছে। নইলে বিচারের বাণী কাঁদত নীরবে নিভৃতে। প্রতিদিন এমনতর ‘কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে। জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে’। তাহলে এভাবেই কি চিরকাল মার খাবে দুর্বল? দুর্বলের প্রতি সবলের অমন ব্যবহারের হাজারো উদাহরণ রয়েছে। নয়া দিগন্তের এক বিশেষ প্রতিবেদনে এসবের উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার থেকে সংসদ সদস্য, মন্ত্রীরা একই আচরণ করছেন। কারণ সম্ভবত একটাই, তারা জনপ্রতিনিধি জনগণের ভোট ছাড়াই। শাসকদলের টিকিটই যথেষ্ট। সুতরাং জনগণকে প্রজা মনে করা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। শাসকদলের প্রত্যেক প্রতিনিধি মনে করেন, ক্ষমতার মালিক তারাই। আমার গ্রাম থেকে এসেছে একজন। তাকে বললাম, ঢাকা শহরে এসেছ সাবধানে চলাফেরা করো। সে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য। বের করে দেখাল আইডি কার্ড। সুতরাং তার সাত খুন মাফ। ঢাকা শহরে ক্ষমতার আধিক্য এতই যে, কয়েক মাস আগে রমনা থানার আওয়ামী লীগের এক কর্মকর্তা ট্রাফিক পুলিশকে ধমক দিয়ে বলেছেন, ‘আমি কে তুই জানিস?’ এ ধমক ট্রাফিকের প্রতি নয়। প্রকারান্তরে এ দেশের কোটি কোটি মানুষের প্রতি। নীতিবাগিশরা বলেন, ‘পাওয়ার করাপ্টস অ্যান্ড অ্যাবসল্যুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসল্যুটলি’। রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত যেভাবে ক্ষমতার রাহু গ্রাস করেছে দেশকে সে ক্ষমতা একচেটিয়া হওয়ার কারণে একচেটিয়াভাবেই জনগণকে গ্রাস করেছে। ফরাসি সম্রাট লুই দ্য সিক্সটিনথ বলতেন, ‘আমিই রাষ্ট্র, আর আইন হচ্ছে আমার আদেশ’। বাংলাদেশে ব্যক্তির কর্তৃত্ব রাষ্ট্র ও আইনকে একাকার করে ফেলেছে।
হাজী সেলিমপুত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। একে ইতিবাচকভাবে দেখছেন অনেকে। ব্যবস্থা না নিলে কী হতো? কিছুই হতো না! কিন্তু ক্ষমতার হিসাব-নিকাশ যারা বোঝেন তাদের কাছে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল। আবারো উদ্ধৃত করি ওবায়দুল কাদেরের কথা। কারো কাছে কোনো ইস্যু তুলে দিতে চায় না আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সতর্ক এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে অসামান্য ঘটনার জন্ম হতে পারে তা তারা জানে। শোনা যায়, ওয়ান-ইলেভেনের আগে-পরে ঔদ্ধত্যের খেসারত দিতে গিয়ে সোনার সংসার ছারখার হয়েছে। ১৯৭৪-৭৫ সালের দিকে এরকম তুচ্ছ ঘটনা অনেক অঘটনের উৎস হয়ে আছে। সুতরাং সাধু সাবধান হবেন এটাই স্বাভাবিক। অবশ্য এর অর্থ এই নয়, সেখানে কোনো মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। জাস্ট আইওয়াশ ফর দ্য সেক অব পাওয়ার। অনেকেই এই ঘটনাকে বলেছেন, ‘ক্ষমতা সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ’। আমরা বলছি শক্তিমানের স্বার্থ। প্রতিপক্ষ যদি শক্তিমান হয় তাহলে শক্তির মোকাবেলায় শক্তি প্রয়োগের সম্ভাবনা থাকে। আর যদি প্রতিপক্ষ শক্তিহীন হয় তাহলে তার কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। মাটির ঘটনা মাটিতেই মিলিয়ে যায়। এ থেকে এই উপলব্ধি-উপসংহারে আমরা উপনীত হতে পারি যে, যারা শক্তি আর ক্ষমতার আধার, তারাই দেশের মালিক-মোক্তার। বাংলাদেশের একজন সমাজবিজ্ঞানী শক্তিমানদের তিন ভাগে ভাগ করেছেন। এ, বি এবং সি। এ ক্ষমতায় আছে। বি ভবিষ্যতের আশা করে। সি যথাস্থানে আছে। তাহলে চতুর্থ সি অর্থাৎ সিটিজেনদের ভবিষ্যৎ কী? তার উত্তরও শক্তির সমীকরণ। সাধারণ মানুষ যদি শক্তি সঞ্চয় করতে পারে তাহলে উত্তর হয়ে যাবে। আর যদি তারা জার্মান নাটক ‘ওয়েটিং ফর দ্য গড’ এর অনুসরণ করে তাহলে হয়তো অনাদি-অনন্তকাল অপেক্ষা করতে হবে। সংঘটিত প্রথম ও দ্বিতীয় ঘটনার পর কেউ কেউ বলছেন, তৃতীয় ঘটনাটি কবে ঘটবে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ যদি নিজেকে নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা ভাবতে পারে তাহলে গডের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।
আমরা তত্ত্বকথার অবতারণা ঘটিয়েছিলাম। ন্যায়-অন্যায় যে শক্তিমানের স্বার্থ দ্বারা নির্ণীত হয় তা দেখিয়েছিলাম। শাসকদল ন্যায়ের ব্যাখ্যা দেয় তাদের মতো করে। এটা হচ্ছে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য শাসকদলের কৌশল। অথবা শক্তির সমীকরণের মহড়া। দৃশ্যমানভাবে সামাজিক ‘ভালোত্বের’ উদাহরণ সৃষ্টি করা যায়। শাসক শক্তির জোরে তার নীতি সমাজের ওপর চাপিয়ে দেয়। প্রশ্ন হতে পারে, আসলেই কি শাসক ন্যায় বোঝে বা ধারণ করে? প্লেটো যুক্তি পরম্পরায় রিপাবলিকে দেখিয়েছেন, শাসক মাত্রই যে তার স্বার্থ সঠিকভাবে বুঝবে তার নিশ্চয়তা নেই। সঠিকভাবে জানা নির্ভর করে জ্ঞানের ওপর। জ্ঞান, নীতি ও সত্যÑ এই হচ্ছে আত্মার সবচেয়ে উত্তম রক্ষক। যখন তা লোপ পায়, তখন তারা ‘ঔদ্ধত্যকে অভিহিত করে আভিজাত্য বলে, অরাজকতাকে বলে স্বাধীনতা এবং অপব্যয়কে মহানুভবতা আর মূর্খতাকে বলে বিক্রম।’
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]