ডামি ইলেকশন, ডামি আন্দোলন

তাসনিম খলিল 
আমার এই পোস্ট লেখার পিছনে দুইটা ঘটনা আছে। প্রথম ঘটনা হইলো, আমি বিএনপির উপর ভরসা করে একটা বাজি ধরছিলাম যে আওয়ামী লীগ এইবার ইলেকশন করতে পারবেনা। বাজিতে আমি এক হাজার ডলার হারছি। দ্বিতীয় ঘটনা হইলো, আমি প্রায়ই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তরুণদের মেসেজ পাই। দেশের রাজনীতিতে কী হচ্ছে, কী হবে এইসব তারা আমার কাছে জানতে চান। এদের মধ্যে বিএনপির গ্রাসরুটসের কর্মীরাও আছেন। ঢাকার এক ছাত্রদল নেতা যেমন অনেক অনেক দিন ধরে ঘরছাড়া, পুলিশ তাকে না পেয়ে প্রায়ই তার বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। তিনি আমাকে ফোন করেন, জানতে চান তাদের ভাগ্যে কী আছে। ভাগ্য গণনা বা রাজনৈতিক বিশ্লেষণে আমি কতটা দুর্বল সেটা প্রথম ঘটনাতেই বোঝা যাচ্ছে, তারপরেও দ্বিতীয় ঘটনার কারণে ওই তরুণদের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা থেকেই এই পোস্ট।
গত দুই বছরে তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপির সাফল্য অস্বীকার করার উপায় নাই। লক্ষ লক্ষ মানুষ বিএনপির আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন এবং সকল নিপীড়ন-নির্যাতন উপেক্ষা করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন। তাদের এই সাফল্য আমাদের অনেকের মনেই আশা জাগিয়েছিলো যে এইবার হয়তো কিছু একটা হবে। ওই কিছু একটা হইলো না কেন? একটা রিয়েল, ভায়াবল আন্দোলন কীভাবে ডামি আন্দোলনে পরিণত হলো? এই প্রশ্নগুলার উত্তর খোঁজা জরুরি।
উত্তর খোঁজার আগে বলে নেই, বিএনপির সাথে আমার আদতে কোনই সম্পর্ক নাই। আমি বিএনপির সদস্য না, সমর্থক না এমনকি তাদের জাতীয়তাবাদের আদর্শিক মিত্রও না। তারপরেও বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে বিএনপির ভূমিকা আমি অস্বীকার করতে পারিনা। পারিনা বলেই বিএনপির ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ আমাকে করতে হচ্ছে।
আমার হিসাবে বিএনপির ব্যর্থতা মূলত তিন জায়গায়: ১) লক্ষ্য সংজ্ঞায়নে ব্যর্থতা; ২) দলীয় আন্দোলনকে গণ-আন্দোলনে রূপান্তরে ব্যর্থতা; ৩) বিদেশ-নির্ভরতা।
১) লক্ষ্য সংজ্ঞায়নে ব্যর্থতা: বিএনপি বাংলাদেশকে একটা পথে হাঁটতে বলেছে কিন্তু পথের শেষে ঠিক কী আছে বা কোন বাহনে সওয়ার হয়ে সেই গন্তব্যে যাওয়া যাবে সেটা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েই গেছে। বিএনপির দশ দফার দ্বিতীয় দফা অনুযায়ী তারা কেয়ারটেকার সরকারের চেয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি কেয়ারটেকার সরকার একটা ডেড হোর্স। ওই মরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বিএনপি কতদূর যেতে পারবে আমি সেটা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম। সন্দিহান ছিলাম কারণ এর ফলে বল চলে গেছে আওয়ামী লীগের কোর্টে এবং “সংবিধানে নাই” এই অজুহাতে সেই বল আওয়ামী লীগ সুন্দর করে খেলে দিয়েছে, কারণ তারা জানতো যে কেয়ারটেকার ইস্যুটা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য একটা বিরাট স্টাম্বলিং ব্লক। এই যে খেলে দিবে সেটাও আমরা অনেকেই বুঝতে পেরেছিলাম, পেরেছিলাম বলেই সংবিধানে আছে এমন একটা ফর্মুলা নিয়ে আলাপ তুলেছিলাম অনেক আগেই। বলাই বাহুল্য সেই আলাপে বিএনপি আগ্রহী ছিলোনা।
২) দলীয় আন্দোলনকে (partisan agitation) গণ-আন্দোলনে (mass-movement) রূপান্তরে ব্যর্থতা: আমার এক সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধু অতিসম্প্রতি বিএনপির এক নেতার সাথে কফি খাচ্ছিলেন। সেই কফিপান পর্বে ওই নেতার প্রশ্ন ছিলো, বিএনপির আন্দোলন সাধারণ জনগণের মধ্যে “ক্লিক” করে নাই কেন? আমার বন্ধু এর উত্তরে একটা লাখ টাকার কথা বলেছেন, “এই সরকারের এগেইনস্টে দাঁড়ানোর জন্য আমার কাছে এক লক্ষ কারণ আছে। কিন্তু আপনার ডাকে রাস্তায় নামার জন্য একটা কারণও নাই।” এইটা একটা নিদারুণ সত্য কথা।
হাসিনাশাহীর বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন সফল করতে হলে এমন একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি  করা প্রয়োজন ছিলো যেখানে বিএনপির যে কর্মীটা তারেক রহমানকে “আগামীর রাষ্ট্রনায়ক” মনে করে সে যেমন আসবে তেমনই আমার বন্ধুর মতো যারা তারেক রহমানকে “বড় গণতন্ত্র” বলে উপহাস করে তারাও আসবে। নন-ভায়োলেন্ট রেজিস্ট্যান্স বা এনভিআরের যে কৌশল বিএনপির নীতিনির্ধারকরা নিয়েছিলেন সেই কৌশল মূলত এই কারণেই ব্যর্থ হয়েছে। এনভিআর স্কলার এরিকা চেনউইথের হিসাবে এমন আন্দোলন সফল করতে হলে মোট জনগোষ্ঠীর ৩.৫%-কে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে হবে। বাংলাদেশে আমরা একটা থিওরিটিক্যাল প্যারাডক্সের মধ্যে আছি। এট লিস্ট ৭২% জনগণ (নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব হিসাবে) নির্বাচন বর্জন করেছে বা পার্টিসিপেট করে নাই কিন্তু ৩.৫%-ও রাস্তায় নামে নাই। কেন? এনভিআরের থিওরি নিয়ে ফেসবুকে আলাপ করার সুযোগ সীমিত, কিন্তু বিএনপির আন্দোলন কেন জনসাধারণের মধ্যে “ক্লিক” করলোনা, সেটা বিএনপিকে বিশ্লেষণ করতে হবে।
৩) বিদেশ-নির্ভরতা: বার্মিজ ডেমোক্রেসি মুভমেন্টের ক্ষেত্রে এরিকা চেনউইথ দেখিয়েছেন যে ওই মুভমেন্ট ব্যর্থ হওয়ার একটা প্রধান কারণ ছিলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনের অভাব। অথচ, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ছিলো এবং আছে। এই সমর্থনে বরং হিতে বিপরীত হয়েছে। বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধীদলগুলার মধ্যে একটা ধারণা জন্মেছে যে লোকাল মুভমেন্টের (স্থানীয় আন্দোলন) বদলে ফরেন ম্যানেজমেন্টের (বিদেশী ব্যবস্থাপনা) মাধ্যমেই বাংলাদেশে হাসিনাশাহীর পতন হবে। এর ফলে আমরা দেখলাম ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো একটা উদ্ভট স্ট্র্যাটেজি নিয়ে তারা এগিয়েছেন।
সুদান, শ্রীলংকা বা ইউক্রেইনে আমরা দেখেছি জনগণ আগে রাস্তায় নামে, তারপরে পশ্চিমা দেশগুলা তাদের আন্দোলনে সমর্থন দেয় — শ্রীলংকার ক্ষেত্রে যেমন, জেভিপির মতো একটা চরম বামপন্থী পার্টিকেও একসময় মার্কিন কূটনৈতিকরা সমর্থন দিয়েছে বা দিতে বাধ্য হয়েছে। অথচ, বাংলাদেশে বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধীদলগুলা আশা করে ছিলো যে আগে মার্কিন-ইউরোপিয়ান স্যাংশন আসবে, তারপরে তারা চূড়ান্ত আন্দোলনে নামবে। এই সুযোগটা নিয়েছে ইন্ডিয়া। তারা মার্কিন এবং ইউরোপিয়ান সরকারগুলাকে বোঝাতে পেরেছে যে হাসিনার বিরুদ্ধে ভায়াবল রেজিস্ট্যান্স গড়ে তোলার ক্ষমতা বিএনপির নাই।
আমার এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বন্ধুর সাথে এই বিষয়ে আলাপ হচ্ছিলো। পশ্চিমাদের দিক থেকে বাংলাদেশে কোনও শক্ত পদক্ষেপ নাই কেন, এইটা ছিলো তার প্রশ্ন: “হোয়াই আর দে স্টিল সিটিং অন দ্য ফেন্স?” উত্তরে আমি বললাম ওরাতো দুর্বল বা মরা ঘোড়ার উপর বাজি ধরবেনা, ধরলে আমার মতোই ধরা খাবে, তাই না?
ফেসবুক পোস্ট