লুট ১৯ হাজার কোটি টাকা

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত থেকে ১৯ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া হয়েছিল ২২ প্রকল্প। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে এসব প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে রেখেছে। বিশেষ করে প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) সব ধরনের কেনাকাটা বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের সাত সদস্যের তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২২ প্রকল্পের বেশির ভাগ নেওয়া হয় ২০১৬ সালে। কয়েকটি প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৭ সাল পর্যন্ত। কয়েকটি প্রকল্পে টাকা বরাদ্দের পরিমাণ কয়েক ধাপে বাড়ানো হয়। প্রতিটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তৎকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তে। এসব প্রকল্পের টাকা ছাড় হতো তাদের সরাসরি সিদ্ধান্তে। কেনাকাটার জন্য তাদের পছন্দের ফার্ম বা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দায়িত্ব দেওয়া হতো। অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্টরা দায়িত্ব নেওয়ার পর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের ২২ প্রকল্পের নানা অনিয়ম জেনে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তদন্ত কমিটিকে ওইসব প্রকল্পের বিস্তারিত জানতে কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন। কমিটি এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। মূলত প্রকল্পগুলোর তিনটি বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এগুলো হলো- কী পরিমাণ টাকা লুটপাট করা হয়েছে, এসবের সঙ্গে সরকার ও রাজনৈতিক দলের কারা সম্পৃক্ত ছিল এবং যেসব প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়েছে সেগুলোর বিস্তারিত।

অনুসন্ধানে জানা যায়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের অধীনে সবচেয়ে বেশি ৫ হাজার ৯২৩ দশমিক ৭৩ কোটি টাকার ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন (ইডিসি) প্রকল্পের কাজ নেওয়া হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে নেওয়া ওই প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০২৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। এতে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় যুগ্ম-সচিব তানজিনা ইসলামকে। প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানাতে অপারগতার কথা জানান তিনি। তবে এ পর্যন্ত ২০০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে। এরপরই রয়েছে ২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকার ইনহ্যানচিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি (ইডিজিই) শীর্ষক প্রকল্প। এর পিডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আরেক যুগ্ম-সচিব সাখাওয়াৎ হোসেন। তৃতীয় সর্বোচ্চ টাকার প্রকল্প ১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকার জেলা পর্যায়ে আইটি/হাই-টেক পার্ক স্থাপন (১২টি জেলায়) ১ম সংশোধিত প্রকল্প। চতুর্থ সর্বাধিক টাকার প্রকল্প ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকার ‘শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি’। ২২ প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে কম টাকার প্রকল্প হচ্ছে ২৭ কোটি টাকার ‘দীক্ষা-দক্ষতা উন্নয়নে শিক্ষা অনলাইনে’। এ প্রকল্পের পিডি হিসেবে মোহাম্মদ কবীর হোসেনের নাম থাকলেও তার কোনো পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। এসব প্রকল্পের বেশির ভাগ পিডি বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে তাদের প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি। ৮৩৭ কোটি টাকার ‘শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার (১১টি প্রকল্প) ১ম সংশোধিত এর পিডি রাজা মুহম্মদ আবদুল হাই বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তার প্রকল্প ২০২০ সালে নেওয়া হলেও কাজ শুরু হয়েছে দেরিতে। আপাতত বন্ধ থাকলেও প্রকল্পের বাজেট কমতে পারে বলে জানান তিনি। ২৮৭ কোটি টাকার হার পাওয়ার প্রকল্প : প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর ক্ষমতায়ন-২য় পর্যায় প্রকল্পের পিডি অতিরিক্ত সচিব মনোয়ারা ইশরাত বলেন, প্রকল্পের ১৮৭ কোটি টাকা এরই মধ্যে খরচ করা হয়েছে। চলতি বছরের জন্য ৭৮ কোটি বরাদ্দ পাওয়া গেছে। লুটপাট করার উদ্দেশ্যে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এসব প্রকল্প নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। তাই বর্তমান সরকারের শুরুর সময়েই ওইসব প্রকল্পের কেনাকাটা একেবারে বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রকল্পগুলোতে যে পর্যন্ত কাজ হয়েছে সেখানেই বন্ধ রাখা হয়েছে। নতুন করে কোনো কাজ করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, প্রথমত প্রকিউরমেন্ট প্রসেস স্বচ্ছ ছিল কি না অর্থাৎ কাউকে কাজ দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে কি না। দ্বিতীয় বিষয় হলো পাঁচ টাকার কাজ পাঁচ টাকায় হয়েছে নাকি ২০ টাকায় হয়েছে- এসব বিষয় আমরা খতিয়ে দেখছি। তিনি জানান, এসব নিয়ে সাত সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর দায়িত্বে আছেন একজন অতিরিক্ত সচিব। কমিটিতে অডিট বিশেষজ্ঞ, লিগ্যাল বিশেষজ্ঞরাও আছেন। তাদের রিপোর্টের জন্য কিন্তু আমরা অপেক্ষা করছি না। যেসব প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন উঠছে যেমন একটি প্রকল্পে হয়তো সাত তলার কাজের মধ্যে পাঁচ তলার কাজ শেষ হয়েছে। আমরা সেটা কেটে দিচ্ছি অর্থাৎ বাদ দিচ্ছি। আবার কিছু প্রকল্পের অধীনে অজপাড়াগাঁওয়ে ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে কিছু করা হলে লোকই খুঁজে পাওয়া যাবে না। পটুয়াখালীতে এরকম একটি জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে কিন্তু আমরা সেটা বাদ দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর আসলে বোঝা যাবে এসব প্রকল্পে কী ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। পরিমাণটাও তখন জানা যাবে। নাটোরের সিংড়ায় সাবেক মন্ত্রী পলক সাহেবের বাড়ির কাছে এত সুন্দর একটি বিল্ডিং করে ফেলা হয়েছে- লাইটটাইট ঝলমলে। বিদেশি ঋণে চমৎকার কম্পিউটার কেনা হয়েছে। কিন্তু কোনো কার্যক্রম নেই। সম্প্রতি আমি সেখানে নিজে গিয়েছিলাম। সেখানে ইউএনওকে দায়িত্ব দিয়ে এসেছি। সচিব জানান, শুধু লুটপাট নয় এসবের সঙ্গে কারা সম্পৃক্ত ছিল সেসবও খতিয়ে দেখা হবে। আমাদের বিভাগের কারা ছিল, রাজনৈতিক কারা ছিল আবার কোন ফার্মকে কাজ দেওয়া হয়েছে সেসব বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

বিতর্কিত ২২ প্রকল্প : ৩৩০ কোটি টাকার মোবাইল গেইম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প, ৮৫৫ কোটি টাকার অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) ২৭ কোটি টাকার দীক্ষা-দক্ষতা উন্নয়নে শিক্ষা অনলাইনে, ৪৪২ কোটি টাকার উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ (৩য় সংশোধিত), ১৫৮ কোটি টাকার গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ (১ম সংশোধিত), ৩০ কোটি টাকার ডিজিটাল সিলেট সিটি শীর্ষক প্রকল্প (২য় সংশোধিত), ৫০৪ কোটি টাকার টেলিযোগাযোগ সুবিধাবঞ্চিত এলাকাসমূহে কানেকটিভিটি স্থাপন (কানেকটেড বাংলাদেশ) প্রকল্প, ১৬৭ কোটি টাকার বিজিডি-ই-গভর্নমেন্টের সক্ষমতা বৃদ্ধি শীর্ষক প্রকল্প, ২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকার ইনহ্যানচিংডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি (ইডিজিই) শীর্ষক প্রকল্প, ৪৯ কোটি টাকার সরকারের ভিডিও কনফারেনসিং প্ল্যাটফরম শক্তিশালীকরণ শীর্ষক প্রকল্প, ৮ কোটি টাকার পার্টনারশিপস ফর এ মোর টলারেন্ট, ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ (পিটিআইবি)। এ ছাড়া বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের অধীনে ৮৩৭ কোটি টাকার শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার (১১টি) প্রকল্প (১ম সংশোধিত), ১ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকার জেলা পর্যায়ে আইটি/হাই-টেক পার্ক স্থাপন (১২টি জেলায়) (১ম সংশোধিত), ৫৩৩ কোটি টাকার শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন (২য় সংশোধিত) প্রকল্প, ৪৩১ কোটি টাকার বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি-২ এর সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প (২য় সংশোধিত), ৩৫৩ কোটি টাকার ডিজিটাল উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবন ইকো-সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্প, ৭৪ কোটি টাকার বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল সেবা ও কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ (বিডিসেট) কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাকরণ শীর্ষক প্রকল্প, ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকার শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি, ১ হাজার ১১৪ কোটি টাকার শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন (১৪টি) প্রকল্প। এ ছাড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর তিনটি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে-৯৩৬ কোটি টাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্প (২য় পর্যায়), ৫ হাজার ৯২৩ কোটি টাকার ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন (ইডিসি) প্রকল্প ও ২৮৭ কোটি টাকার হার পাওয়ার প্রকল্প : প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর ক্ষমতায়ন-২য় পর্যায় প্রকল্প।

উৎসঃ বিডি প্রতিদিন