সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের মরদেহের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। তিনি কলকাতায় খুন হয়েছেন বলে ২২ মে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তবে মৃতদেহ পাওয়া না গেলে সংসদে তাঁর আসন শূন্য ঘোষণা নিয়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে আনোয়ারুল আজীমের আসনটি শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করার কথা। নির্বাচন কমিশনেরও ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আনোয়ারুল আজীম একাধারে সংসদ সদস্য ও পরিবহন ব্যবসায়ী। তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব পরিচালনার জন্যও মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
১২ মে চিকিৎসার জন্য ব্যক্তিগত সফরে ভারতে যান ঝিনাইদহ-৪ আসনের টানা তিনবারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম (আনার)। ১৭ মে থেকে পরিবারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন তাঁর নিখোঁজের বিষয়ে উত্তর কলকাতার বরানগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন সেখানকার বন্ধু গোপাল বিশ্বাস। এরপর সংসদ সদস্যের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস (ডরিন) ঢাকায় গোয়েন্দা সংস্থা ডিবির কাছে বাবার নিখোঁজের অভিযোগ দেন।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ১৩ মে রাতে খুন করা হয় আনোয়ারুলকে। কলকাতা পুলিশ তাঁর মরদেহ উদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছে। এর মধ্যে ১২ দিন পেরিয়ে গেলেও মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।
সাম্প্রতিক অতীতে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম (লিটন) নিজ বাড়িতে খুন হন। এরও আগে আহসান উল্লাহ মাস্টার সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় খুন হন। তবে তাঁদের মরদেহ নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল না। ফলে মৃত্যুর পরপর সংসদ সচিবালয় আসন শূন্য ঘোষণা করে উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করে।
সংসদ সদস্য মারা গেলে কিংবা অনুমতি ছাড়া ৯০ কার্যদিবস সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে পদ শূন্য ঘোষণা করে সংসদ সচিবালয়। এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনকে জানায় সংসদ। নির্বাচন কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচনের আয়োজন করে। সাধারণত কোনো সংসদ সদস্যের মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যেই আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়। সংসদ সদস্য মারা গেলে স্পিকার শোক প্রস্তাব গ্রহণ করেন। সংসদের অধিবেশন চলাকালে কেউ মারা গেলে ওই দিনের জন্য অধিবেশন মুলতবি করার রেওয়াজ আছে।
সংসদ সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কে এম আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, এ সপ্তাহে বিষয়টি নিয়ে স্পিকারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সংসদবিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে কোনো সংসদ সদস্যের মৃত্যু অতীতে ঘটেনি। সাধারণত কারও মৃত্যুর ক্ষেত্রে মৃত্যু সনদ দেওয়া হয়। এখানে কীভাবে তা করা হবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। মরদেহ বা দেহবাশেষ না পেয়ে মৃত্যু সনদ দেওয়া হলে আইনি প্রশ্ন ওঠার সুযোগ থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করছে। আসন শূন্য ঘোষণা করতে অসুবিধা হবে না বলে তিনি মনে করেন।
সম্পদ ও উত্তরাধিকার
২০০৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আনোয়ারুল। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে প্রথমবার সংসদ সদস্য হন আনোয়ারুল। সেই থেকে টানা তিনবার তিনি ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া আনোয়ারুল আজীমের হলফনামা অনুসারে, তাঁর পেশা ব্যবসা ও কৃষি।
সংশ্লিষ্ট নানা সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংসদ সদস্যের পরিবহন ব্যবসা রয়েছে। ডরিন পরিবহন নামে বাস যশোর-খুলনা রুটে চলাচল করে। তবে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় তাঁর বা পরিবারের সদস্যদের বাসের মালিকানার কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। তবে চারটি ট্রাকের মালিক তাঁর স্ত্রী বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে।
আনোয়ারুল আজীম পরিবহনমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহসভাপতি। এই সমিতির সভাপতি জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত নেতা মসিউর রহমান এবং মহাসচিব ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। আনোয়ারুল কালীগঞ্জে উপজেলা মোটর মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। পরিবহন খাতের সূত্রগুলো বলছে, ওই অঞ্চলের পরিবহন ব্যবসায় তাঁর বেশ শক্ত নিয়ন্ত্রণ ছিল।
হলফনামা অনুসারে, সংসদ সদস্য এবং তাঁর স্ত্রীর নগদ টাকা আছে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার মতো। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা প্রায় ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। নিজের একটি গাড়ি ও স্ত্রীর নামে চারটি ট্রাক রয়েছে।
স্থাবর সম্পদের মধ্যে আনোয়ারুল আজীমের নিজের নামে ৩৩ বিঘা কৃষিজমি রয়েছে। যার মূল্য প্রায় ৪৩ লাখ টাকা। তাঁর স্ত্রীর নামে আছে সাড়ে ২৪ শতাংশ কৃষিজমি। সংসদ সদস্যের অকৃষি জমির পরিমাণ ১২৯ শতাংশ। স্ত্রীর রয়েছে ১৭৯ শতাংশ। দুজনের অকৃষিজমির মূল্য দেখিয়েছেন ৮২ লাখ টাকার বেশি। কালীগঞ্জ পৌর এলাকায় তাঁর একটি চারতলা বাড়ি রয়েছে। জনতা ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখায় ১ কোটি ১৭ লাখ টাকার মতো ঋণ থাকার কথা হলফনামায় উল্লেখ আছে।
হলফনামা অনুসারে, আনোয়ারুল আজীমের বিরুদ্ধে অতীতে হত্যা ও চোরাচালানসহ ২১টি মামলা ছিল। এর সব কটি থেকেই তিনি অব্যাহতি কিংবা খালাস পেয়েছেন।
আনোয়ারুল কৃষি থেকে বছরে দুই লাখ টাকার মতো বছরে আয় করেন। ব্যবসা থেকে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা প্রায় ৩৮ লাখ টাকা বছরে আয় করেন। আর সংসদ সদস্য হিসেবে বেতন ও ভাতা পান বছরে প্রায় ২৪ লাখ টাকা।
সংসদ সদস্যের স্ত্রী ও দুই মেয়ে রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে মৃত ঘোষণা না করা হলে সম্পদের উত্তরাধিকার নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। আর নিখোঁজ হলে অন্তত সাত বছর পর্যন্ত উত্তরাধিকারেরা সম্পদের মালিকানা পান না।
বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এর আগেও সংসদ সদস্য খুন হওয়ার ঘটনা আছে। তবে লাশ না পাওয়ার বিষয়টি নতুন। আসন শূন্য ঘোষণা কিংবা মৃত্যু নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংসদ সচিবালয়কে অবহিত করতে পারে। সংসদ সচিবালয়ও জানতে চাইতে পারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে। এর বাইরে সংসদ সচিবালয় ও নির্বাচন কমিশনের নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। আর মৃত্যু নিশ্চিত হলে উত্তরাধিকার প্রশ্নেও ঝামেলা হবে না।
prothom alo