সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মুখোমুখি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। উত্তপ্ত রাজনীতি। উদ্যোগ নেই সংলাপের। দৃশ্যমান মধ্যস্থতাকারীও নেই। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ডেকেছে বিএনপি।
এ ব্যাপারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছি আমরা। আন্দোলনের বিভিন্ন ধাপ সফলভাবে পেরিয়ে এখন শেষ পর্যায়ে। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া স্বৈরশাসককে ক্ষমতা থেকে সরাতে আজ সারাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ। আন্দোলনে মানুষের অংশগ্রহণ ও দেশপ্রেম দেখে আমরা অভিভূত। তবে সরকার জনগণের মনের ভাষা বুঝতে পারছে না। আমরা আশা করছি, জনগণের আন্দোলনে সাড়া দিয়ে সরকার অবিলম্বে পদত্যাগ করবে। অন্যথায় সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে যত কঠোর কর্মসূচি দেওয়া প্রয়োজন, তার সবই দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, সরকার নির্বাচনে বিরোধী নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে কাজে লাগাতেই আনসার বাহিনীকেও আটকের ক্ষমতা দিয়ে সংসদে বিল তুলেছে।
অবশ্য বিগত দুটি আন্দোলনে ‘ব্যর্থ’ বিএনপি। কৌশল গ্রহণেও ‘সফল’ হয়নি তারা। ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন এবং ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণও ‘ভুল’ ছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের অনেকেই। তবে বিএনপি নেতাদের দাবি, সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন তারা। নির্বাচন বর্জন ও অংশগ্রহণে সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগণকে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপির দাবি সঠিক ও যথাযর্থ, যা এরই মধ্যে দেশে-বিদেশেও সমর্থন পেয়েছে। তবে এবারের আন্দোলনের সফলতা নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা বেশ আশাবাদী হলেও সন্দিহান রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সরকারের সশস্ত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা সুসংগঠিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং সুবিধাভোগী সরকারি কর্মকর্তাদের প্রবল শক্তির সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল বিএনপি কি রাজপথে দাঁড়াতে পারবে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির নেতাকর্মীরা এবার অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে নেমেছেন। আঘাত এলে পাল্টা আঘাত করতে প্রস্তুত তারা। যে কোনো মূল্যে মহাসমাবেশ সফল করে আন্দোলনকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে কয়েক দিন ধরে দলের হাইকমান্ড, কেন্দ্রীয়, মহানগর, জেলাসহ মাঠ পর্যায়ের নেতারা ধারাবাহিক বৈঠক করছেন। গতকাল মঙ্গলবার গুলশান কার্যালয়ে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি, মহিলা দলের বৈঠকসহ বিভিন্ন সেলের প্রস্তুতি বৈঠক হয়।
একই সঙ্গে সমমনা দল ও জোটের ৩৬ দলও আলাদা সমাবেশ সফল করার বৈঠকে মিলিত হচ্ছে। গত সোমবার গুলশান কার্যালয়ে ভার্চুয়ালি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা প্রথম বৈঠকে আন্দোলনের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করেন। ওই বৈঠকে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সমমনা নেতারা পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে সচিবালয় ঘেরাওসহ সরকারের ভূমিকার ওপর নির্ভর করে সম্ভাব্য কয়েকটি নতুন কঠোর কর্মসূচির প্রস্তাব দিয়েছেন। এরই মধ্যে চূড়ান্ত কর্মসূচি হিসেবে ঢাকাসহ সারাদেশে রাজপথ-রেলপথ-নৌপথ অবরোধের কর্মসূচিও রয়েছে।
সূত্র জানায়, ধারাবাহিক বৈঠকে সরকারের নানা হুমকি-ধমকি এবং মহাসমাবেশে সম্ভাব্য নানা বাধাবিঘ্নকে সামনে রেখেই কৌশলী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বিএনপি নেতারা। আন্দোলনের কৌশল ফাঁস হয়ে গেলে সরকার সতর্ক হয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দলীয় নেতাকর্মীকে আগাম জানানো হচ্ছে না।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল গতকাল সমকালকে বলেন, বিএনপির পাশাপাশি সমমনা দলগুলো দফায় দফায় বৈঠক করে মহাসমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে সফল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কোনো আঘাত এলে পাল্টা আঘাত করার ব্যাপারেও প্রস্তুত থাকবে বিএনপি ও সমমনা দলের নেতাকর্মীরা। বিভাগীয় শহরে সফরকালেও আমরা স্থানীয় নেতাদের আন্দোলনের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিয়ে এসেছি।
অবশ্য গতকাল রাত পর্যন্ত বিএনপিকে নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশের অনুমতি দেয়নি পুলিশ। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। তবে এবার নয়াপল্টনের পরিবর্তে গোলাপবাগের মতো মূল শহরের বাইরে কোনো ভেন্যু পুলিশ প্রস্তাব করলে তা মেনে নেবেন বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতারা। নয়াপল্টনকেই ভেন্যু ধরে সার্বিক প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি।
এরই মধ্যে ঢাকামুখী হয়েছেন সারাদেশের দলীয় নেতাকর্মীরা। গ্রেপ্তার এড়াতে এবার গাড়ি ভাড়া করে একসঙ্গে আসছেন না তারা। বাস-ট্রেনসহ নানা গণপরিবহনে সাধারণ যাত্রীবেশে ঢাকায় আসছেন। ঢাকায়ও কোনো হোটেল বা মেসে উঠছেন না। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বাসায় অতিথি হিসেবে অবস্থান করছেন। রাজধানীতে সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করছেন। ঢাকাসহ সারাদেশে ধরপাকড় অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। নেতাকর্মীরা রাতে নিজ বাসাবাড়িতে অবস্থান না করলেও গ্রেপ্তার এড়াতে পারছেন না। পুলিশ এরই মধ্যে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে বলে দাবি করেছে দলটি।
জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন সমকালকে বলেন, মহাসমাবেশ থেকে চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। তারা গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করবেন। ২৮ অক্টোবর একই দিনে শাপলা চত্বরে জামায়াতের সমাবেশ কর্মসূচি দেওয়ার যোগসূত্র আছে কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে যে কোনো দল রাজপথে ভূমিকা রাখতে পারে। তাতে আমাদের কিছু বলার নেই। এদিকে জামায়াতে ইসলামীও একই দিন শাপলা চত্বরে সমাবেশের ডাক দেওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা গুঞ্জন চলছে। তাহলে ভেতরে ভেতরে কি বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ রয়েছে নাকি জামায়াত বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে নিজেদের কর্মসূচি দিয়ে বিএনপিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাচ্ছে? অবশ্য বিএনপি নেতারা বলছেন, জামায়াতের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। জামায়াত নিজেদের মতো করে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে। আবার দু-একজন নেতা প্রশ্ন রেখে বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ থাকতে পারে। বলা যায় না, তারা কোন দিকের ইন্ধনে সমাবেশ ডেকেছে!