রাজনীতিতে জাতীয় সমঝোতায় খুঁজতে হবে নতুন ফর্মুলা

পুরাকালের কথা। এক নারী গলায় কলসি বেঁধে নীরব-নিস্তব্ধ রাতে এক সরোবরে নামছিলেন। হঠাৎ এক যুবক এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কী করছেন? উত্তর আসে, কিছু না। তাহলে তিনি পানিতে কেন—এমন প্রশ্ন করতেই নারী বললেন, সমাজে তাঁর কলঙ্ক রটেছে, এখন তিনি কী করবেন? যুবক ওই নারীকে জীবনের পথে ফিরে আসতে আহ্বান করেন; তাঁর হাত ধরেন।

‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’ বইটিতে নীরদচন্দ্র চৌধুরী (যিনি ‘আত্মঘাতী বাঙালী’রও লেখক) কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বউদি কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এমন একটি ঘটনার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, কাদম্বরীকে জীবনের দিকে টেনে তোলার জন্য তাঁর হাত ধরার মতো কেউ ছিল না।

বাংলাদেশের নির্বাচনপূর্ব সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি সেই পুরাকালের আত্মহননেচ্ছুক নারীর অসহায়ত্বের মতো জাতীয় অসহায়ত্বকে তুলে ধরছে। সংকট সর্বজনস্বীকৃত, কিন্তু তা নিরসনের কোনো লক্ষণ নেই। আছে জনজীবন নিয়ে নীরব হাহাকার, কিছু আনুষ্ঠানিক বাগ্‌বিতণ্ডা।

এ দেশের ইতিহাস যাঁরা গড়েছিলেন, সেই তরুণদের বর্তমান প্রজন্ম দৃশ্যপটে বলা যায় অনুপস্থিত। তাঁদের কেউ চাকরিপ্রার্থী। কেউ শিক্ষার্থী হিসেবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।

কেউ বিদেশে যেতে মরিয়া। তরুণ প্রজন্মের একটা বিরাট অংশ রাজনীতিকে ঘৃণার চোখে দেখছে। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, এ দেশ রাজনীতিসংক্রান্ত সংকটসহ বহুবিধ সমস্যায় এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে এর সমাধান আর সম্ভব হবে না।

হয়তো প্রচলিত রাজনৈতিক বয়ান তাঁদের কাছে আবেদনহীন সস্তা প্রলাপ। অথবা সব প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক দলীয়করণ ও মোটাদাগের জাতীয় বিরাজনৈতিকীকরণের ফলই রাজনীতি সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে এ ধারণার জন্ম দিয়েছে।

রাষ্ট্রযন্ত্র ও বিরোধীদলীয় জোট বিপরীতমুখী দাবি ও অবস্থান নিয়ে পরস্পরের মুখোমুখি। দাবিটি ১৯৯০ ও পূর্ববর্তী দশকে যে অবস্থায় ছিল, এখনো তা-ই আছে।

এক পক্ষ চাইছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। অন্য পক্ষের তাতে ঘোর অস্বীকৃতি। পার্থক্য হচ্ছে, সে সময় রাজনৈতিক দলের বাইরেও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার মতো বেশ কিছু বিবেকবান, যোগ্য ও সাহসী মানুষ ছিলেন।

তাঁরা সংকট নিরসনে উদ্যোগ নিয়েছেন, মধ্যস্থতাও করেছেন প্রয়োজনে। কিন্তু এখন সিভিল সোসাইটি নামক জিনিসটি হয় পক্ষপাতদুষ্ট, না হয় অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

রাজনৈতিক সমীকরণটি দাঁড়িয়েছে এমন যে এক পক্ষ শুধু জিতবেই না, সবকিছু গ্রাস করবে। আরেক পক্ষ সব হারাবে। কোনো পক্ষই অহংবোধটিকে বিসর্জন দিতে চায় না। শাসক দল আওয়ামী লীগ মনে করে এবং বলেও, ক্ষমতা হারালে তারা আক্রমণের শিকার হবে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা না থাকা বিএনপির পরিষ্কার ভাষ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া মুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ পাওয়া সম্ভব নয়। এই অচলাবস্থা দূর করতে সংলাপের মার্কিন আহ্বানে সাড়া মেলেনি। বরং একতরফা নির্বাচন বনাম আন্দোলনের চলমান ধারাই কঠিন সত্য।

এ অবস্থায় শিগগিরই প্রাণবন্ত সংসদীয় গণতন্ত্রের সম্ভাবনা তেমন দেখা যাচ্ছে না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কার্যকর সংসদ উপহার দেয়নি জাতিকে। দেশে-বিদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জোরদার হওয়ায় আরেকটি একতরফা নির্বাচন মানে রাজনৈতিক বৈধতার সংকট আরও গভীর হওয়া; আবারও জোড়াতালির ব্যবস্থা চলতে থাকা।

এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও আরও অনিশ্চয়তার শঙ্কা।

তাহলে কে ঠেকাবে এই রাজনৈতিক হারিকিরি? শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের সুযোগ তৈরি করতে দেখা যাচ্ছে না দেশীয় কোনো উদ্যোগ, যেখানে দলীয় বৃত্তের বাইরের উদ্যোগ দলগুলো খোলা মনে আলোচনা করতে পারে।

রাজনৈতিক দল ও বিদেশি কূটনীতিকদের বাইরে সংশ্লিষ্টদের নির্লিপ্ততা দেখে মনে হয়, রাজনৈতিক সংলাপের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই এ মুহূর্তে। অনেক মানুষ হয়তো আশা করছেন, শিগগিরই সংকট কেটে যাবে, যেমন বিপরীত শিবিরের সুবিধাবাদীরা কল্পনা করেন, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবেন প্রতিপক্ষ আর নেই।

রাজনৈতিক ‘অভিনেতা’ ও ‘কাপুরুষ’ নাগরিকদের অংশটির এ ধরনের অবাস্তব চিন্তাধারার কারণে সংকট দীর্ঘায়িত হয় মাত্র। অথচ জনগণ সমাধান চায়। পূর্ণ সমাধান। তাদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধান।

এটাও আমাদের বোঝা দরকার, সেই সমাধান বিরাজমান রাজনৈতিক শক্তিগুলো বাদ দিয়ে হওয়ার নয়।

আন্দোলন-সংগ্রাম ও নির্বাচনে হারার ভয়, দল হিসেবে নিঃশেষিত হওয়ার ভয় নেতৃত্বকে তাড়া করে বেড়ায়। সেই সঙ্গে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিজয়ী দলের সব ক্ষমতা পাওয়ার অধিকার গণতান্ত্রিক চর্চা ও সংস্কৃতিকে দুর্বল করে রাখে।

তারপরও নির্বাচন ও আন্দোলনের সংঘাতে সমাধান অসম্ভব ভেবে তো আর পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করলে চলে না।

দলগুলো সাড়া দেবে কি না—এ ভাবনায় তাড়িত না হয়ে বরং জন-আকাঙ্ক্ষার সপক্ষে রাজনৈতিক সমাধানের উপায় নিয়ে কথা বলা জরুরি। যেহেতু বিরাজমান সাংবিধানিক ব্যবস্থা কার্যকর গণতন্ত্র, রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্প্রীতি এবং জাতীয় সমঝোতা নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছে, তাই খুঁজতে হবে নতুন, গ্রহণযোগ্য ও টেকসই ফর্মুলা।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজাতে জনগণ, সুনির্দিষ্টভাবে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী, পেশাজীবী, বিবেকবান, সরব মানুষ এবং রাজনৈতিক অংশীজন—সবাইকে নিয়ে সংলাপ হতে পারে।

পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে, বিশেষ করে ইউরোপে, সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে যেভাবে আধুনিক গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছিল, আমাদের আবার ‘কখগঘ’ থেকে শুরু করতে হতে পারে।

তবে তা হবে দেশীয় পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায়। গণতন্ত্র যে এক দিনের ভোটের ব্যবসা নয়, তা নিশ্চিত করতে হয় প্রতিদিনের অনুশীলন দিয়ে; জনগণের অধিকার রক্ষার সদা জাগ্রত ও সক্রিয় প্রহরী রেখে।

যেহেতু ক্ষমতা (শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব) সহজাতভাবেই দুর্নীতি ও অপব্যবহারপ্রবণ, তা প্রহরী মনে করা হয় সংসদ, বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম, সাংবিধানিক সংস্থা এবং সামাজিক চাপ ও মতামত প্রদানকারী গোষ্ঠীগুলোকে।

বাংলাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য অকার্যকর হয়ে পড়ায় সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক সমস্যা বা সংকটের সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এটাও ঠিক, রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হলে সংবিধান কখনো কোনো বাধা হয় না।

রাজনৈতিক শক্তিগুলো জনগণ ও সামাজিক গোষ্ঠীগুলোকে যে সমাধান দিয়ে থাকে, তা এখন উল্টো করেও ভাবা দরকার। তা ছাড়া ভোটাধিকারসহ নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলো যেমন শুধুই দলীয় অ্যাজেন্ডা নয়, এগুলোর দায়িত্বও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের একার নয়।

যদি ধরে নিই, দলগুলো দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে, তাহলেও কি আমাদের জাতীয় সমাধানের প্রয়োজন নেই?

তাই বলে ১৭ কোটি জনগণ বা ১২ কোটি ভোটারই তো রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হবে না কোনো এক শহরে। যারা নতুন বার্তা, রাজনৈতিক বয়ান ও জনকল্যাণের অ্যাজেন্ডা তৈরির সামর্থ্য রাখেন, তাঁদের উচিত ঘরের বাইরে এসে কথা বলা।

এই সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের যুগে ভোট ছাড়াও মানুষের সমর্থন বোঝার কিছুটা উপায় তো আছে। এ দেশে গণতান্ত্রিক রায়ের যখনই সুযোগ এসেছে গণ-মানুষ খুব একটা ভুল করেনি; গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে তাদের প্রবল উৎসাহ প্রমাণ করেছে।

এখন বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাব করতে পারেন, কী হবে রাষ্ট্রীয় কাঠামো, কেমন হবে সাংবিধানিক ও আইনগত ব্যবস্থা, কীভাবে পুনরুজ্জীবিত করা যাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক অধিকারগুলোকে।

সমবেতভাবে ভাবা উচিত, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার কী করে রোধ করা যাবে এবং গণমুখী আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, সমাজ গঠন, কী করে সর্বোত্তম মানে উন্নীত করা যায়, সে প্রচেষ্টার সময় এখন।

যাঁরা গাছ লাগান, তাঁরা সাধারণত ফল খেতে পারেন না। তাই আমাদের প্রজন্মের প্রচেষ্টা ও ত্যাগের উদ্দেশ্য বংশধরদের জন্য সুন্দর দেশ, প্রতিশ্রুতিশীল রিপাবলিক বা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ করা।

কেবল এক দিনের নির্বাচন অনুষ্ঠানভিত্তিক গণতন্ত্র থাকলে বিজয়ীরা স্বৈরাচারী হতে উদ্বুদ্ধ হবে। অন্যদিকে নির্বাচকমণ্ডলী বা ভোটাররা গণতন্ত্রের সুফল থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবে।

এ দেশে অবশ্যই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উজ্জ্বল ইতিহাস আছে এবং গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। সেগুলো থেকে আজকের অবস্থায় আমাদের শিক্ষা এই যে কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ায় ঘাটতি এবং গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব ও নাগরিক সমাজ নির্মাণে বিচ্যুতি ছিল।

যাঁরা সৎভাবে এসবের দায় নিতে চান, তাঁরা জাতীয় ক্ষতিপূরণে অবদান রাখতে পারেন কিংবা দায়িত্ব বোধ থাকলে দেশের জন্য ভাবতে পারেন নতুন উদ্দীপনায়।

ক্ষমতার দাবিদার দলগুলোর মধ্যে যে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব ও জিঘাংসা তৈরি হয়েছে, নতুন জনচুক্তি তাদের জন্য হতে পারে অনাক্রমণ চুক্তি। সেই প্রক্রিয়ায় যে কেউ অংশ নিতে পারেন।

আবার বিবদমান রাজনৈতিক শিবিরের মধ্যে আপনারা বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ বাদ দিয়ে এক পক্ষের সংকীর্ণ বয়ানের অংশীদার হতে পারেন; আবার ‘পোপের চেয়েও বেশি পবিত্র’ নিরপেক্ষ ভূমিকাও নিতে পারেন।

তাতে অবশ্য আপনার বিচক্ষণতা, মহানুভবতা এবং সৎসাহস প্রকাশ পাবে না। আজকে আপনার একটি বিশেষ দায়িত্ব পালনের সুযোগ এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি অর্থপূর্ণ সংলাপে আনার পরিবেশ সৃষ্টিতে, প্রস্তাবের খসড়া ও অ্যাজেন্ডা প্রণয়নে এবং সংকট সমাধানের ফর্মুলা প্রদানে তৃতীয় পক্ষের প্রাসঙ্গিকতা আছে নিশ্চয়ই।

সবাই মিলে একটি নতুন জনচুক্তিতে পৌঁছানো এবং সই করার মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য, বিশেষ করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, ভবিষ্যৎ নির্মাণের আরেকটি চেষ্টা করলে ক্ষতি কী?

প্রথম আলো

  • খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক।