মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও চীনের রাষ্ট্রমালিকানাধীন সিআইটিআইসি রাখাইন রাজ্যে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলার কাজ জোরদার করতে একমত হয়েছে। এ লক্ষ্যে দুই পক্ষ আগের চুক্তিতে একটি ধারা যোগ করে তাতে স্বাক্ষর করেছে। গত মঙ্গলবার দেশটির রাজধানী নেপিডোতে এই চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠান হয়।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কর্মকর্তা ও চীনা দূতাবাসের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন উপপ্রধানমন্ত্রী ও পরিবহনমন্ত্রী মিয়া তুন এবং সরকারি দপ্তর বিষয়কমন্ত্রী অং নাইং। মিয়ানমার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির চেয়ারম্যান হলেন অং নাইং। সিআইটিআইসির নির্বাহীরাও উপস্থিত ছিলেন।
মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম দ্য ইরাবতী জানিয়েছে, এ প্রকল্পের উন্নয়নের দায়িত্বে রয়েছেন চাওকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গভীর সমুদ্রবন্দর কোম্পানি। সরকারের চাওকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ব্যবস্থাপনা কমিটি ও চীনের সিআইটিআইসি মিয়ানমার পোর্ট ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড যৌথভাবে এই গভীর সমুদ্রবন্দর কোম্পানির মালিক।
চুক্তিতে ঠিক কী আছে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। তবে বাণিজ্য বিশ্লেষকেরা মনে করেন, চীনা ব্যবসায়ীরা যাতে প্রকল্পটির কাজ নিয়ে এগিয়ে যান, সে জন্য মিয়ানমারের সামরিক সরকার সম্ভবত বেশ কিছু সুবিধা দিয়েছে।
এ প্রকল্পে মালিকানায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। এখানে চীনের মালিকানা থাকবে ৭০ শতাংশ, বাকি ৩০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ থাকবে মিয়ানমারের হাতে। ২০১৮ সালে এ প্রকল্প নিয়ে দর–কষাকষির সময় দুই পক্ষ এ ব্যবস্থায় একমত হয়েছিল।
চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটারের একটি অর্থনৈতিক করিডর এখন গড়ে তোলা হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হলো ভারতীয় মহাসাগরের সঙ্গে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিংয়ের সংযোগ ঘটানো। চাওকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চাওকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দর এই বিশেষ করিডরের অংশ।
চাওকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার। আর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে খরচ হবে ৭৩০ কোটি ডলার। রাখাইন রাজ্যের চাওকপিউ টাউনশিপে মাদে দ্বীপে ১৫০ হেক্টর ও রামরি দ্বীপে ৯৬ হেক্টর জমিতে এ দুই প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে।
চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে এই চুক্তি হলো এমন সময়ে, যখন মিয়ানমারের সামরিক সরকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুদ্ধে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হচ্ছে। চীনের সীমান্তসংলগ্ন উত্তরের শান রাজ্যে এ লড়াই চলছে সেনাবাহিনী ও ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত জোটের মধ্যে।
মিয়ানমার সরকারের জন্য সে কারণে চীনের সাহায্য প্রয়োজন। সীমান্তের এসব জাতিগোষ্ঠীর ওপর বেইজিংয়ের বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে।
শান রাজ্যে এ যুদ্ধের ফলে চীনের ‘অঞ্চল ও পথ’ কর্মসূচির আওতায় বিনিয়োগ এবং সীমান্ত–বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। চীন মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের মধ্যে দুবার আলোচনার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু লড়াই শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়নি; বরং গত দুই মাসে সরকার শান রাজ্যে বড় এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
চাওকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হলে চীন ভারত মহাসাগরে সরাসরি প্রবেশপথ পেয়ে যাবে। ফলে মালাক্কা প্রণালি এড়িয়ে চীন জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারবে এবং ভূবেষ্টিত ইউনান প্রদেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতে পারবে।
চাওকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য চীনা কোম্পানিটি ২০১৫ সালে দরপত্রে অংশ নিয়েছিল। এরপর ২০১৮ সালে দুই পক্ষের মধ্যে একটি কাঠামোগত চুক্তি হয়। সে সময়ে ক্ষমতায় ছিল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি সরকার, যাদের হটিয়ে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে।
দুই পক্ষই এখন প্রকল্পটি দ্রুত এগিয়ে নিতে কাজ শুরু করবে। কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পটি শেষ হলে এটি হবে একটি ব্যবসা কেন্দ্র, যা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের সঙ্গে সংযোগ ঘটাবে। তাঁরা বলেন, এটি মিয়ানমার ও এই অঞ্চলে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে এবং এ অঞ্চলের জন্য একটি নতুন দ্বার উন্মোচন করবে।
কর্মকর্তারা যাই–ই বলুন না কেন, দ্য ইরাবতী জানাচ্ছে যে গত বছর পর্যন্ত স্থানীয় বাসিন্দারা এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যাচ্ছিলেন। তাদের যুক্তি, এ প্রকল্প স্থানীয় মৎস্য সম্পদের ক্ষতি করবে। বাণিজ্য বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়নেও সমস্যা হবে। এর কারণ হলো, চাওকপিউর সঙ্গেই রামরি অঞ্চল, যেখানে এখন লড়াই চলছে।
প্রথম আলো