বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের রপ্তানির হিসাবের ‘অসামঞ্জস্য’ দূর করার পদক্ষেপ দেশের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান ওলট–পালট করতে চলেছে। কেবল ১০ মাসের সংশোধিত তথ্যেই প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ‘আয়’ উধাও হয়ে গেছে। দুই বছরের হিসাবে উধাও হওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার। ফলে রপ্তানি আয়ের এই চুপসে যাওয়া পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার কমে যেতে পারে।
প্রাথমিকভাবে হিসাব করে দেখা গেছে, রপ্তানি আয়ের সংশোধনের ফলে বাংলাদেশের জিডিপির আকার কমবেশি ২ শতাংশ কমতে পারে। পরিমাণের দিক থেকে তা প্রায় ৯ বিলিয়ন বা ৯০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ বর্তমান বাজারদরে (প্রতি ডলারের দাম ১১৫ টাকা ধরে) জিডিপির আকার ১ লাখ কোটি টাকার বেশি কমে যেতে পারে। জিডিপির আকার কমলে স্বাভাবিকভাবে মাথাপিছু আয়ও কমবে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ সালের সাময়িক হিসাবে জিডিপির আকার ছিল ৪৫৯ বিলিয়ন ডলার।
সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) রপ্তানির ‘প্রকৃত তথ্য’ প্রকাশ করে। সেখানে ইপিবির প্রকাশ করা তথ্যের সঙ্গে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ফারাক পাওয়া গেছে। এর পর থেকে রপ্তানির তথ্যের গরমিল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, যদিও ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন যে ইপিবি রপ্তানি আয়ের ফোলানো-ফাঁপানো তথ্য দিচ্ছে।
একটি দেশের অভ্যন্তরে এক বছরে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার সামষ্টিক মূল্যই হলো জিডিপি। আগের বছরের তুলনায় পরের বছর যে মূল্য সংযোজন হয়, তাকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বলা হয়। একইভাবে মূল্য সংযোজন কমে গেলে অর্থনীতি সংকুচিত হয় বা নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়—এসব বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করে থাকে। জিডিপির গণনায় ভোগ ও বিনিয়োগের পাশাপাশি রপ্তানি খাতের মূল্য সংযোজন যুক্ত হয়। গত মে মাসে প্রথম ছয়-সাত মাসের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিদায়ী অর্থবছরের জিডিপির সাময়িক হিসাব দেয় বিবিএস।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রপ্তানি কমলে জিডিপির আকার কিছুটা কমবে। তবে আমাদের অর্থনীতিতে রপ্তানির অবদান খুব বেশি না। কারণ, রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন হয় তুলনামূলক কম। বিশেষ করে পোশাক খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থের কাঁচামাল আমদানি করে রপ্তানি পণ্য বানাতে হয়।’
মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, রপ্তানির পরিমাণ কমে যাওয়ার বিদায়ী অর্থবছরের জিডিপির চূড়ান্ত হিসেবে পরিবর্তন আসবে। আকার কমার পাশাপাশি কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের অবদানেও হেরফের হতে পারে।
সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ১০ মাসে ইপিবির হিসাবে, আর্থিক মূল্যে পণ্য ও সেবা রপ্তানির পরিমাণ ৪৭ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন (৪ হাজার ৭৪৭ কোটি) ডলার। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ওই সময়ে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন (৩ হাজার ৩৬৭ কোটি) ডলারের রপ্তানি হয়েছে। দুই হিসাবের পার্থক্য ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন (১ হাজার ৩৮০ কোটি) ডলার।
ইপিবির হিসাবে জিডিপিতে অবদান ৩০ বিলিয়ন ডলার
রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণে কীভাবে ও কতটা জিডিপির আকার কমতে পারে, তা হিসাব করে দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশ থেকে যত পণ্য রপ্তানি হয়, তার ৮৫ শতাংশই তৈরি পোশাক। বাকি রপ্তানি আয় আসে চামড়া ও চামড়াজাতীয় পণ্য, চা, পাট ও পাটজাতীয় পণ্য, প্লাস্টিক, খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্য থেকে।
ইপিবির হিসাবে, ১০ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৪০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন (৪ হাজার ৩৫ কোটি) ডলারের। রপ্তানি করা পোশাকের সুতা, কাপড়সহ অন্যান্য কাঁচামাল আমদানি করতে খরচ হয় এ খাতের মোট রপ্তানির প্রায় ৪০ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ। সেই হিসাবে ওই সময়ে ১৬ দশমিক ১৪ বিলিয়ন (১ হাজার ৬১৪ কোটি) ডলারের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়েছে। বাকি ২৪ দশমিক ২১ বিলিয়ন (২ হাজার ৪২১ কোটি) ডলার স্থানীয়ভাবে করা মূল্য সংযোজন। জিডিপির হিসাবে এই পরিমাণ অর্থই যুক্ত হয়।
জুলাই থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময়ে পোশাক ছাড়া অন্যান্য পণ্য রপ্তানি ৭ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার ছিল বলে ইপিবি জানিয়েছে। তবে পোশাকের তুলনায় এসব পণ্যে স্থানীয় মূল্য সংযোজনের হার অনেক বেশি। এসব পণ্যে প্রায় ৯০ থেকে শতভাগ দেশীয় মূল্য সংযোজন হয়। কম হার, অর্থাৎ ৯০ শতাংশ মূল্য সংযোজন ধরা হলে এসব পণ্যের রপ্তানি থেকে জিডিপিতে যুক্ত হয়েছে ৬ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার।
ইপিবির দেওয়া রপ্তানি হিসাব বিবেচনায় নিলে, জুলাই-এপ্রিল সময়ে পোশাক ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করে জিডিপিতে মোট মূল্য সংযোজন হয়েছে ৩০ দশমিক ৬১ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৬১ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে অবদান ২১ বিলিয়ন ডলার
কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশে আসা রপ্তানি আয়ের তথ্য-উপাত্ত বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে সংগ্রহ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, এই তথ্যের সঙ্গে প্রকৃত রপ্তানি আয়ের ‘তেমন পার্থক্য থাকে না’। গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক এই প্রকৃত রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করে। এই তথ্যে দেখা গেল, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন (৩ হাজার ৩৬৭ কোটি) ডলারের পণ্য ও সেবা। অর্থাৎ ইপিবির সঙ্গে ‘প্রকৃত রপ্তানি আয়ের’ পার্থক্য ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই রপ্তানির ‘প্রকৃত তথ্য’ জিডিপির আকারে প্রভাব রাখবে। যেহেতু মোটাদাগে মোট রপ্তানির ৮৫ শতাংশই তৈরি পোশাক, তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ১০ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ২৮ দশমিক ৬২ বিলিয়ন (২ হাজার ৮৬২ কোটি) ডলারের। কাঁচামাল আমদানির জন্য ৪০ শতাংশ অর্থ বাদ দিলে স্থানীয় মূল্য সংযোজন হয়েছে ১৭ দশমিক ১৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭১৭ কোটি ডলারের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বিবেচনায় পোশাক ছাড়া অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৫ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। ৯০ শতাংশ মূল্য সংযোজন ধরা হলে জিডিপিতে যুক্ত হবে ৪ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি হিসেবে জুলাই-এপ্রিল সময়ে পোশাক ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করে জিডিপিতে মোট মূল্য সংযোজন হয়েছে ২১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন (২ হাজার ১৭১ কোটি) ডলার।
জিডিপি কমতে পারে ৯ বিলিয়ন ডলার
বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানির তথ্য চূড়ান্ত হিসেবে ধরা হয়। তাই রপ্তানি খাত থেকে জিডিপিতে অবদান কমে যাবে। হিসাব করে দেখা গেছে, ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের ফারাক থাকায় এখন জিডিপিতে রপ্তানি খাতের অবদান প্রায় ৯ বিলিয়ন বা ৯০০ কোটি ডলার কমে যেতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) টাকার পাশাপাশি ডলারেও জিডিপির আকার কত, তা প্রকাশ করে থাকে। বিবিএসের সাময়িক হিসাবে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির আকার প্রায় ৪৫ হাজার ৯০০ কোটি বা ৪৫৯ বিলিয়ন ডলার। ফলে রপ্তানির নতুন তথ্যে জিডিপির আকার কমতে পারে ২ দশমিক ১৩ শতাংশ।
তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হিসাবে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরেও রপ্তানি আয় বাবদ ১২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের মতো কম হয়েছে। ফলে আগের অর্থবছরেও জিডিপির আকার কমবে। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জিডিপির ভিত্তি কমে যাওয়ায় সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বড় প্রভাব পড়বে না।
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নাম প্রকাশে একজন কর্মকর্তা জানান, রপ্তানির তথ্য সংশোধনের কারণে জিডিপির আকার কিছুটা কমতে পারে। তবে আনুষ্ঠানিক হিসেবে জিডিপির আবার কত কমবে, তা নির্ভর করবে পুরো বছরের সব খাতের চূড়ান্ত হিসাব পাওয়ার পর। তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বড় কোনো পরিবর্তন হবে না বলে তিনি মনে করেন।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন ধরে রপ্তানি আয় অনেক বেশি দেখানো হয়েছে। ফলে এর প্রতিফলন ঘটেছে জিডিপি, মাথাপিছু আয়সহ সংশ্লিষ্ট সব খাতে। এখন ভুলটি ঠিক করা হয়েছে। এটিই চূড়ান্ত নয়; আরও পর্যালোচনা করা উচিত।’ তাঁর মতে, রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় জিডিপির আকার কমপক্ষে ৮-৯ বিলিয়ন (৮০০-৯০০ কোটি) ডলার কমতে পারে।
আহসান এইচ মনসুর পরামর্শ দেন, শিগগিরই লেনদেনের ভারসাম্য (ব্যালান্স অব পেমেন্টস) পর্যালোচনা করা উচিত। এই কাজের জন্য প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করার দরকার নেই। রপ্তানি আয়ের প্রকৃত তথ্য ঠিক করেই সব হিসাব-নিকাশ চূড়ান্ত করা উচিত।
PROTHOM ALO