যুবলীগ নেতা জেম হত্যা: ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামের দুর্নীতি নিয়ে লাইভে বক্তব্যের ৪ দিনের মাথায় নিহত হন যুবলীগ নেতা

 আমার দেশ
২৪ এপ্রিল ২০২৩

নিহত খাইরুল আলম জেম ও ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম

নিহত খাইরুল আলম জেম ও ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম

নিজস্ব প্রতিনিধি

ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম কর্তৃক হিন্দু সম্পত্তি দখল, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে জাল সনদ ব্যবহার ও দুর্নীতি নিয়ে লাইভে বক্তব্য দেওয়ার চার দিনের মাথায় নিহত হন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা খাইরুল আলম জেম। এই হত্যাকাণ্ডে ক্রীড়নক হিসেবে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু, জীবনের ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ।

খাইরুল আলম জেম চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও জেলা যুবলীগের সাবেক সহ শ্রমবিষয়ক সম্পাদক, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সদস্য। তার বাড়ি শিবগঞ্জ পৌরসভার মর্দনা গ্রামে।

ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম কর্তৃক হিন্দু সম্পত্তি দখল, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে জাল সনদ ব্যবহার ও স্থানীয় সন্ত্রাসে মদদের তথ্য প্রকাশ করে ফেইসবুক লাইভে বক্তব্য রেখেছিলেন এই যুবলীগ নেতা। লাইভে বক্তব্যের ৪ দিন পরই গত ১৯শে এপ্রিল নিহত হন। তাঁর এই হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে সৈয়দ নুরুল ইসলামের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি এলাকার মানুষের মুখে মুখে প্রচার হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পুলিশ কর্মকর্তা সৈয়দ নুরুল ইসলাম স্থানীয় এক হিন্দুর ৬৮ বিঘা দেবোত্তর সম্পত্তি দখল ও স্থানীয় সন্ত্রাসী কার্যকলাপে মদদে জড়িত। তার এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় নেপথ্যে থেকে এই হত্যাকাণ্ডে মদদ দিয়েছেন সৈয়দ নুরুল ইসলাম। যদিও এ বিষয়ে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

নিহত হবার ৪ দিন আগে যুবলীগ নেতা খাইরুল আলম জেম ফেসবুক লাইভে এসে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামের নাম ও কর্মকাণ্ড উল্লেখ করে দীর্ঘ এক বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেই বক্তব্যটি ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়েছে।

লাইভে নিজ এলাকার রাজনৈতিক রেষারেষির বর্ণনার এক পর্যায়ে খাইরুল আলম জেম বলেন, “ওই এলাকায় ২০১৫ সাল থেকে এই সৈয়দ নুরুল ইসলাম একটি ৬৮ বিঘা দেবোত্তর সম্পত্তি ওই এলাকার চিহ্নিত ডাকাত-সন্ত্রাসী আবদুস সালামকে দিয়ে জবরদখল নেন। আমি ওই গ্রামে ১৯৮২ সাল থেকে বসবাস করি না। ওই জমির মালিক শ্রী কমল ত্রিদেবী তাকে আমি কোনোদিন চিনতাম না। আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। এখানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ বিশ্বাস এমপির সাথে আমি রাজনীতি করি। ওই শ্রী কমল ত্রিদেবী এমপি আব্দুল ওদুদ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করতে আসে আমার মাধ্যমে। এটাই আমার সবচাইতে বড় অপরাধ। ওই সৈয়দ নুরুল ইসলাম ওই ৬৮ বিঘা দেবোত্তর সম্পত্তির একটা ইটভাটা ৩টা পুকুর, আমের গাছ … তার (ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম) লোভ-লালসা থাকতে পারে। কিন্তু ওই জমির প্রতি তো আমার কোনো লোভ লালসা নাই। আল্লাহ আমার বাপ-দাদাকে যথেষ্ট দিয়েছে। আমি এখানে রাজনীতি করি। এমপির খুব কাছাকাছি থেকেছি আমি। এই এলাকার কোনো মানুষ বলতে পারে না কোনো মানুষের জমি দখল করেছি, প্রতারণা করেছি।”

ফেসবুক লাইভে খাইরুল আলম জেম আরও বলেন, “সৈয়দ নুরুলের কাছে আমি বেশ কয়েকবার গেছি। তাকে আমি আহ্বান করেছিলাম, আল্লাহ আপনাকে সম্মান দিয়েছে। আপনি ভালো জায়গায় চাকরী করছেন। আপনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মধ্যমণি থাকবেন। আপনি গায়ে পোশাক পইরা (পুলিশের ইউনিফর্ম) মানুষকে (গ্রামের) দিনকে রাত, রাতকে দিন বোঝাচ্ছেন। …. আপনার ভাইকে আমি ওই এলাকায় নৌকায় ভোট করে দিয়েছি। ভোটের দিন সকালে আপনার সাথে আমার কথা হয়েছিল। মনে আছে আপনার? কোনোদিন প্রকাশ করেছি?”

ভিডিও বার্তায় ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমি আপনার কাছে করজোড়ে, পা ধরে একটি কথা বলব … সৈয়দ নুরুল ইসলাম। চাকরীটা আপনার অবৈধ। আপনার বাপ মুক্তিযোদ্ধা ছিলো না। আপনি (অস্পষ্ট) সার্টিফিকেট নিয়া ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হইসেন। স্বপ্ন দেখছেন, আইজিপি হওয়ার। আপনি হন। সেখানে আমার কোনো দেখার বিষয় না। বলারও বিষয় না। আপনি সাধারণ মানুষের … আপনি আমাকে গুলি করে মেরে ফেলেন, জেলে দেন …. কিন্তু, এলাকার সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে আপনাকে। আর যদি না করেন.. তাহলে আমি বলছি ওই গ্রামের সকল নারী পুরুষ শহরে এসে অনশন করবে এবং দেশবাসীকে একটা জিনিস জানিয়ে দেবে এই ডিআইজির হাত থেকে ওই বিরামপুর গ্রামের মানুষকে…. ।”

লাইভের ৪ দিন পর ১৯শে এপ্রিল শহরের উদয়ন মোড় এলাকায় প্রকাশ্য জনসম্মুখে জেমকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। হত্যা তালিকায় আরও ১০ জনের নাম শোনা যাচ্ছে অথচ পুলিশ নির্বিকার এমনটাই অভিযোগ করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ।

নৃশংস এই খুনের সাথে জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সোমবার (২৪শে এপ্রিল) চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি জানানো হয়।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- জেলা কৃষক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেসবাহুল হক টুটুল, মাসুদ রানা, মো. ইব্রাহিম, মো. শামীম রেজা, মিলন হোসেন, মো. রুনু, মো. রোকনুজ্জামান, রনি ও মেরাজ খোনা।

জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এ এইচ এম আব্দুর রকিব বলেন, জেম হত্যার পর থেকে এজাহারভুক্ত আসামিরা আত্মগোপনে চলে যান। পরবর্তী সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল রোববার একটি দূরবর্তী জেলা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তবে কোথা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়, এ বিষয়ে পুলিশ সুপার কিছু জানাননি। পুলিশ সুপার আরও বলেন, গ্রেপ্তার আসামিদের আজ আদালতে সোপর্দ করা হবে। এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে রিমান্ডের আবেদন করা হবে।