যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা নির্বাচনকেন্দ্রিক, নাকি ভূরাজনৈতিক

এবারের এই নির্বাচন ঘিরে প্রধান বিরোধী ও অন্যতম বৃহত্তর দল বিএনপি, সমমনা ও বাম দল আন্দোলনে ছিল। বলতে গেলে এখনো রয়েছে। বেশ কিছুদিন বিভিন্ন দলের সমাবেশে সরকারি দলের সঙ্গে খুব কম সংঘর্ষ ছাড়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল।

বিরোধী জোটের দাবি ছিল, এ সরকারকে রেখে নির্বাচন নয়। কারণ, বিগত দুটি নির্বাচন যে দেশে বা দেশের বাইরে গ্রহণযোগ্য হয়নি, তাতে এখন কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। রাজনৈতিক দল এবং দলের সমর্থকদের বাইরে মানুষের আকাঙ্ক্ষা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। সে দাবি এখন যে অবস্থায় রয়েছে, তা কতখানি পূরণ হবে, সেটি দেখার বিষয়।

শুধু ভিসা নীতি ঘোষণা করেই শান্ত থাকেনি যুক্তরাষ্ট্র; বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নানা তৎপরতা আমরা লক্ষ করছি, যা আগে দেখা যায়নি। যদিও ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের তৎপরতা ছিল দৃশ্যমান ও লক্ষণীয়। এবার যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে বেশ তৎপর দেখা গেছে, যদিও ২৮ অক্টোবরের পর কিছুটা গা ছাড়া ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের তৎপরতা বন্ধ করেছে—এমন মনে করার কোনো কারণ নেই।

২৮ অক্টোবর বিএনপি ও অন্যান্য দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সহিংসতার পর রাজনীতিতে একধরনের অচলাবস্থা দেখা দেয়। এ পরিস্থিতির মধ্যেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। এর দুই দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু বড় তিন দলকে নিঃশর্ত সংলাপের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠান। চিঠির জবাবে সরকারি দল বলেছে, এখন আর সংলাপের সময় নেই।

এত দিন সরকারি দলেরই আহ্বান ছিল নিঃশর্ত সংলাপের, কিন্তু কথিত সময়ের অভাবে তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। বাকি দুই দলের তেমন কোনো বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু হয় এবং তাঁদের অধিকাংশই এখন কারাগারে। নাশকতায় জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কিছু নেতাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আর অনেকেই পলাতক।

এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ডেকে যাচ্ছে। এভাবে কত দিন চলবে, তা বলা যাচ্ছে না। তবে দৃশ্যত বিএনপি ও আরও কিছু দলকে বাদ দিয়ে নানা কূটকৌশলে সরকার নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তারা টানা চতুর্থবারে মতো ক্ষমতাসীন হতে চাইছে।

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে উথালপাতাল চলছে, তার পেছনে অনেক দেশের রাজনীতিতে বহুদিন ধরে সক্রিয় বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ কাজ করেছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। আগেই বলেছি, এবার যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের তৎপরতা বিশেষভাবের লক্ষণীয়।

অনেকেই মনে করছেন, আগামী নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতায় ভাটা পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার যে একতরফাভাবে নির্বাচন করার সব উদ্যোগ নেবে, তা কি যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় ছিল না? তফসিল ঘোষণার সব আয়োজন যখন শেষ, তখন সংলাপের চিঠি দেওয়ার তাৎপর্য কী? নির্বাচন কমিশন তো এটা আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এখানেই শেষ, না সামনে আরও কিছু আছে?

বাংলাদেশের উদার গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এত তৎপরতা কি শুধুই বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে দেশে ও দেশের বাইরে গ্রহণযোগ্য করা? নাকি এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক কৌশলগত স্বার্থ কাজ করছে? সাধারণ মানুষের কাছে এর সহজ–সরল উত্তর হচ্ছে, বাংলাদেশে চীনের প্রভাব কমানো। তবে আমি মনে করি, এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য এই পুরো অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানো।

এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে যে দেশের ওপর চীনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, সেই দেশ হচ্ছে মিয়ানমার। এ অঞ্চলে ভূরাজনৈতিকভাবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ হচ্ছে মিয়ানমার। এর ভৌগোলিক অবস্থান—একদিকে বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর এবং আরেক দিকে চীন সাগরের কাছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের অন্যতম দীর্ঘ অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে। বিশাল অর্থনৈতিক বিনিয়োগের কারণে মিয়ানমার চীনের স্থায়ী প্রভাববলয়ের মধ্যে রয়েছে।

গত নির্বাচনে মিয়ানমারে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির বিজয় হলেও সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ওই নির্বাচন বানচাল করে দলটির নেতা অং সান সু চিকে অন্তরীণ করা হয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তর করার কোনো পথ খোলা রাখেনি। শুরু হয়েছিল গণ-অভ্যুত্থান, যা কঠোর হাতে দমন করা হয়েছে। এই সামরিক জান্তার সহযোগী হিসেবে রয়েছে চীন।

এরই মধ্যে ২০২৩ সালে বার্মা অ্যাক্টের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে সু চির দলের উদ্যোগে যে প্রতিরোধ, বিশেষ করে সশস্ত্র প্রতিরোধ চলছে, তাকে সাহায্য করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বার্মা অ্যাক্টের বিষয়টি তাই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট বা এনইউজির পক্ষে মিয়ানমারের বড় বড় সশস্ত্র গোষ্ঠী দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল দখল করেছে বলে দাবি করা হচ্ছে।

এমনকি সরকারি সামরিক বাহিনী থেকে দলত্যাগের খবরও প্রচারিত হচ্ছে। বাংলাদেশ–সংলগ্ন চিন রাজ্য এবং থাইল্যান্ড সীমান্তসংলগ্ন শান রাজ্য সংঘাতের মুখে। চিন ও আরাকান অঞ্চল এখন আরাকান আর্মির প্রভাবে রয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান দৃশ্যমান নয়।

সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা অ্যাক্ট যে কার্যকর হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বার্মা অ্যাক্টকে ত্বরান্বিত করতে মিয়ানমারের প্রতিবেশী যে দুটি দেশ গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে পূর্বে থাইল্যান্ড, পশ্চিমে বাংলাদেশ। কাজেই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার পেছনে শুধু দেশে একটি গ্রহণযোগ্যতা ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান নয়, এর সঙ্গে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিও যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের এই সম্প্রসারিত ভূরাজনৈতিক উদ্যোগ এ অঞ্চলে কতখানি কার্যকর হবে এবং আগামী দিনে বাংলাদেশের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক থাকবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

  • ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
  • প্রথম আলো