যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড লুর আগেই আসছেন ভারতের সৌরভ কুমার

Bhorer Kagoj

যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড লুর আগেই আসছেন ভারতের সৌরভ কুমার

সংলাপে ভুল ধারণা দূর হবে, আশা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমানভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক প্রতিযোগিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে। এর প্রভাবে দেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরগরম হয়ে উঠেছে কূটনৈতিক পাড়া। গেল কয়েক মাসে ঢাকায় প্রভাবশালী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিক ও জাঁদরেল কর্মকর্তাদের আনাগোনা বেড়েছে। আগামীতে এর সংখ্যা আরো বাড়বে বলে ধারণা করছে সংশ্লিষ্ট মহল।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আগামী সপ্তাহে ঢাকায় আসছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। পরের সপ্তাহে আসছেন অর্থনৈতিক বিষয়ের আন্ডার সেক্রেটারি জোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজ। পৃথকভাবে আসা দলটি সংকট সমাধানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও সুশীল সমাজসহ বিশিষ্ট দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে মধ্যস্থতার চেষ্টা করবে। ১০ জুলাই থেকে এ সফর শুরু হবে এবং প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ১৩ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করবেন।

এদিকে অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, আমেরিকান প্রতিনিধিদলের আগেই বৃহস্পতিবার ঢাকা আসছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব (পূর্ব) সৌরভ কুমার। একদিনের সফরে আসা সৌরভ কুমার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে। অর্থাৎ, লুর আগেই আসেছেন সৌরভ। সব মিলিয়ে এই বছরে বাংলাদেশে নির্বাচনী কূটনীতিও জমে উঠেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যেসব তৎপরতা শুরু হয়েছে- তা নিয়েই আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটবে সরকারের।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফর নিয়ে আগে থেকেই কৌতূহল ছিল। নতুন করে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব (পূর্ব) আসার খবরে কৌতূহল আরো বেড়েছে। তবে অনেকের আগ্রহ ডোনাল্ড লুকে ঘিরেই ঘুরছে। গত জানুয়ারির পর এটি হবে বাংলাদেশে ডোনাল্ড লুর দ্বিতীয় ঢাকা সফর। সেবার লু ঢাকা ঘুরে যাওয়ার পরই মে মাসে বাংলাদেশের জন্য নতুন মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণা করা হয়েছিল। এর আগে পাকিস্তানে ইমরান খান সরকারকে হটাতে ডোনাল্ড লুর নামই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সরাসরি ডোনাল্ড লুকে দায়ী করেছেন। এরপর থেকে ‘লু’কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে ‘রেজিম চেঞ্জ’ স্পেশালিস্ট বলেও অনেকেই উপাধি দিয়েছেন।

তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন মনে করছেন, নির্বাচন সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসছেন, সংলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের ভুল ধারণা দূর হবে। গতকাল সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আলাপকে স্বাগত জানায় বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে উচ্চ পদস্থ কূটনীতিকরা বাংলাদেশে আসছেন, তাদের সঙ্গে সংলাপে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর হবে। তবে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন বা র‌্যাবের কয়েকজন সদস্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা উঠবে কিনা- তা ওই দেশটির বিষয় বলে মনে করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

তিনি বলেন, র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি পুরোটাই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নিভর করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয়া হয়েছিল। যেই প্রচেষ্টা এখনো চলছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে সরকার চিন্তিত নয় বলেও জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে রাজনীতির মাঠ নতুন মাত্রায় উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস এবং ১২ কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তুলে জোরালো চিঠি ও বিবৃতি দিয়েছেন। এর পাল্টা হিসেবে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। ফলে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিনিধিদলের সফর চূড়ান্ত হওয়ায় বহুমুখী গুরুত্ব বেড়েছে।

সূত্র জানায়, মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফরের আলোচ্যসূচিতে মূলত নির্বাচন ও গণতন্ত্রের মতো বিষয় রয়েছে। আমেরিকা ২০১৪ এবং ২০১৮-এর মতো নির্বাচন দেখতে চায় না। সেজন্য সমঝোতার চেষ্টা করা হবে। রাজনীতি ও নির্বাচনের পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকট ও শ্রমিক অধিকার গুরুত্বপূর্ণ হবে এই আলোচনায়। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিদেশি হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে আলোচনায় বসবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, তারা কেন আসছেন তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে এই সফর যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক কথা বলছে। হয়তো তারা এসব বিষয়েই কথা বলবে। সবমিলিয়ে সফরটি গতানুগতিক হবে না বলেই মনে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নির্বাচনের এই বছরটা অবশ্য শুরুই হয়েছে নানামুখী কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে। গত বছরের শেষ মাসে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পূর্বাপর এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার এবং চীনের মধ্যকার পাল্টাপাল্টি সেই চ্যালেঞ্জে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন পরাক্রমশালী দেশের কূটনীতিকদের প্রকাশ্য মন্তব্য ও তৎপরতা সরকারের অস্বস্তি বাড়াচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ বছর বন্ধুত্ব বাড়ানো এবং বজায় রাখার কূটনীতিতে জোর দিচ্ছে সরকার। লক্ষ্য একটাই, নির্বাচনী বছরে যেন কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি না ঘটে। দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরো নিবিড় করতে সংশ্লিষ্ট মিশনপ্রধানদের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দলীয়ভাবে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। পিছিয়ে নেই বিএনপি এবং সরকারবিরোধী অন্য দলগুলোও। আগামী নির্বাচনে বিশ্বশক্তির সমর্থন পক্ষে টানতে তারাও সক্রিয়।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে তত এমন সফর আরো বাড়বে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের তৎপরতা আগেও ছিল। এবারতো আরো বেশি থাকবে।

তিনি বলেন, আমি মনে করি, নির্বাচনের কতগুলো দিক এখনো ঠিক হয়নি। নির্বাচনে বিরোধী দল আসবে কিনা। যদি আসে তাহলে কী হবে, না আসলে কী হবে- সেসব বিষয়ে প্রতিনিধিদল জানতে চাইবে। মার্কিন প্রতিনিধিদলের আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব (পূর্ব) সৌরভ কুমার আসছেন- এখানে অন্য কোনো বার্তা আছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতেরও একটা আগ্রহ আছে। তার মতে, শুধু ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্র নয়, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রতির প্রেক্ষাপটে আরো অনেক দেশই আসতে চাইবে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনটি বিষয় আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে : নির্বাচন কীভাবে পরিচালিত হবে, বিরোধী দল কতটা শক্তিশালী এবং আমেরিকার চাপের প্রভাব কী হতে পারে। তবে এটা ঠিক, গত এক বছরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু, বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হ্যাস এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাউন্সিলর ডেরেক চোলেটসহ সে দেশের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রকাশ্যে আহ্বান জানিয়েছেন। অন্য কয়েকটি দেশও যুক্তরাষ্ট্রের পথ অনুসরণ করেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং চীন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্ত, বঙ্গোপসাগরে কৌশলগত অবস্থান এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনা- এটিকে ইন্দো-প্যাসিফিক প্রতিযোগীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় মিত্র করে তুলেছে।

এমকে