মুডির ঋণমান কমানো দেশের অর্থনীতির নতুন সঙ্কট

Daily Nayadiganta (নয়া দিগন্ত) : Most Popular Bangla Newspaper

  • ড. মো: মিজানুর রহমান
  • ৩১ ডিসেম্বর ২০২২

– ছবি : সংগৃহীত

আজকের প্রবন্ধের শিরোনাম দেখে ফাইন্যান্স সেক্টরের ঋণমান বা ক্রেডিট রেটিং সম্পর্কে অভিজ্ঞ নন এমন পাঠকের বিষয়টি বোধগম্য না-ও হতে পারে বিধায় এ নিয়ে বিস্তারিত লেখার আগে ব্যাংকের ঋণমান কী, কেন করা হয়- সে বিষয়ে আলোচনা করব। এরপর ভালো বা খারাপ রেটিং অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলতে পারে সে বিষয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

ক্রেডিট রেটিং কী কেন?
কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে ঋণ দেয়া হলে তা ঠিক সময়ে পরিশোধ করার সক্ষমতা কতটা আছে, সেটিই ঋণমানের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়। যেমন- আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কোনো দেশ যদি ঋণ নিতে চায়, তখন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এই রেটিংয়ের ভিত্তিতে বুঝতে পারে, দেশটি সময়মতো ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কতটা আছে। ক্রেডিট রেটিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সক্ষমতা, অতীত ইতিহাসের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। সেই রেটিং থেকে ক্রেতারা বা ঋণদাতা অথবা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বুঝতে পারে, তাদের সাথে লেনদেন করা কতটা নিরাপদ। তারা ঋণ পরিশোধে কতটা সক্ষম। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের ভেতরে ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে লেনদেন করতে হয়। এই ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের ঋণমানের ভিত্তিতে ঋণের শর্তাবলি ও সুদের হার নির্ধারণ হয়ে থাকে। কাজেই রেটিং ভালো হলে সহজ শর্তে, কম সুদে ঋণ পাওয়া যায়। রেটিং খারাপ হলে ঋণদাতারা সেটি ঝুঁকি হিসেবে দেখে এবং কঠিন শর্ত ও বেশি সুদ আরোপ করে। এ কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময়ই চায় যাতে তাদের ক্রেডিট রেটিং ভালো হয়।

বিভিন্ন দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরও সাধারণ গ্রাহকদের আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে ক্রেডিট রেটিং করা হয়ে থাকে। সেই রেটিংয়ের ভিত্তিতে তারা ঋণ পাবেন কি না এবং কতটা পাবেন তা নির্ধারণ করা হয়। আবার শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগের আগে বা শেয়ার কেনার আগে বিনিয়োগকারীরা ক্রেডিট রেটিং দেখে ওই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সক্ষমতা, তাদের বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ, কত তাড়াতাড়ি উঠে আসবে ও কেমন মুনাফা পেতে পারেন তা বুঝতে পারবেন।

কিভাবে ক্রেডিট রেটিং করা হয়ে থাকে?
আর্থিক খাতের একাধিক সূচক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ক্রেডিট রেটিং করা হয়ে থাকে। যেমন- ওই ব্যাংকের আমানত কেমন আছে, সেটি কোন খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেখান থেকে তারা রিটার্ন কেমন পাচ্ছে, গ্রাহক ফেরত চাইলে কত তাড়াতাড়ি সেই আমানত ফেরত পাবে ইত্যাদি ওই রেটিং দিয়ে বোঝা যায়। এ ছাড়াও কোন খাতে তাদের ঋণ বেশি দেয়া হয়েছে, সেখানেঝুঁকি কেমন আছে, আন্তর্জাতিক কোনো ব্যাংকের দায়দেনা মেটাতে তাদের সক্ষমতা কেমন আছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ কতটা সুদৃঢ় ইত্যাদিও বোঝা যায়। একেকটি প্রতিষ্ঠান একেক রকম সূচক বিবেচনায় নিয়ে কাজ করে বলে রেটিংয়ে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। তবে সাধারণত আন্তর্জাতিক সংস্থার ক্রেডিট রেটিংয়ে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখা যায় না।

রেটিংয়ের জন্য বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাগ করা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, কোম্পানির আর্থিক ভিত কতটুকু মজবুত কিংবা দুর্বল এগুলোর ওপর ভিত্তি করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে রেটিং করা হয়ে থাকে। দীর্ঘমেয়াদে রেটিংগুলোর নাম হলো- ট্রিপল-এ, ডাবল-এ, সিঙ্গেল-এ, ট্রিপল-বি, ডাবল-বি, সিঙ্গেল-বি, ট্রিপল-সি, ডাবল-সি, সিঙ্গেল-সি এবং ডি। প্রতিষ্ঠানের মূলধন, আমানত, দেশী ও বৈদেশিক বিনিয়োগ, ঋণের খাত, ঋণ পরিশোধের হার ইত্যাদি সূচক বিবেচনায় নিয়ে এটি নির্ধারণ করা হয়। কোনো কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদে ‘ট্রিপল-এ’ রেটিং পাওয়ার মানে হলো, সক্ষমতার দিক থেকে এটি অত্যন্ত মজবুত। এই কোম্পানিতে ঝুঁকি খুবই কম। ‘ডাবল-এ’ দিয়ে খুবই মজবুত ক্যাপাসিটি ও স্বল্প ঝুঁকিপূর্ণ এবং ‘সিঙ্গেল-এ’ দিয়ে মজবুত ক্যাপাসিটি ও স্বল্প ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানি বোঝায়। ‘ট্রিপল বি’ দিয়ে সন্তোষজনক ক্যাপাসিটি ও মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ বোঝায়। ‘ডাবল বি’ দিয়ে অপর্যাপ্ত সক্ষমতা ও অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানি বোঝায়। ‘সিঙ্গেল-বি’ দিয়ে দুর্বল ক্যাপাসিটি ও উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানি বুঝায়। ‘ট্রিপল সি’ দিয়ে খুবই দুর্বল ক্যাপাসিটি ও খুবই উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানি বোঝায়। ‘ডাবল সি’ দিয়ে অত্যন্ত দুর্বল ক্যাপাসিটি ও অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানি এবং ‘সিঙ্গেল সি’ দিয়ে ব্যর্থতার দিকে অগ্রসর হওয়াকে বোঝায়। সর্বশেষ ‘ডি’ রেটিং দিয়ে ব্যর্থ কিংবা অস্তিত্বহীন অথবা দেউলিয়া কোম্পানিকে বোঝায়। অন্য দিকে, স্বল্পমেয়াদের জন্য ‘এসটি-১’ রেটিং দিয়ে সর্বোচ্চ গ্রেড; ‘এসটি-২’ দিয়ে হাই গ্রেড; ‘এসটি-৩’ দিয়ে মাঝারি গ্রেড; ‘এসটি-৪’ ও ‘এসটি-৫’ দিয়ে অপর্যাপ্ত গ্রেড এবং ‘এসটি-৬’ রেটিং দিয়ে সর্বনিম্ন গ্রেড বোঝায়।

ক্রেডিট রেটিং কারা করে?
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মুডিস, স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুউর এবং ফিটচ রেটিং এজেন্সি অন্যতম। বাংলাদেশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মুডিস রেটিং এজেন্সি দিয়ে রেটিং করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই সংস্থাটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও দেশের ক্রেডিট পরিস্থিতি যাচাই করে থাকে। বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবেও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্রেডিট রেটিং সনদ দিয়ে দিয়েছে। সাধারণত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে চুক্তির ভিত্তিতে, অনেক সময় নির্দিষ্ট ফি’র বিনিময়ে তারা রেটিং করে থাকে।

উল্লেখ্য, সব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান চায়, তাদের ক্রেডিট রেটিং ভালো হোক। কারণ, এই রেটিং বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ পাওয়া, এলসি খোলা ইত্যাদিতে ভূমিকা রাখে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি দেশীয় ব্যাংকের এলসি গ্রহণ করতে সম্মত হয়নি কিছু ব্যাংক। এর পেছনে এই রেটিং কমে যাওয়ার ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

একইভাবে ব্যক্তি পর্যায়ের গ্রাহকদের লেনদেন বা আর্থিক রেকর্ড কেমন, সেটি যাচাই করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো’ নামে একটি দফতর আছে। যখন কেউ ঋণ নিয়ে থাকে, সেটি ঠিকভাবে পরিশোধ করেছেন কি না, ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনে বকেয়া রয়েছে কি না, খেলাপি হয়েছেন কি না, ব্যুরোর প্রতিবেদন থেকে জানতে পারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এর ভিত্তিতে তারা ঋণ দেয়া না দেয়া, কতটা ঋণ মঞ্জুর করা হবে, ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।

দেশের ক্রেডিট রেটিং কিভাবে করা হয়?
অর্থনীতিবিদরা বলেন, যখন কোনো দেশের ক্রেডিট রেটিং করা হয়, তখন তার সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন রয়েছে তা দেখা হয়। সে দেশে বিনিয়োগের অবস্থা, স্টক এক্সচেঞ্জ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিষয়ও বিবেচনায় রাখা হয়। বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণ, বাণিজ্যিক লেনদেন পরিশোধের সক্ষমতা কতটা আছে, সেটি দেখা হয়। ক্রেডিট রেটিং ভালো হলে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ বা আর্থিক সহায়তা সহজ শর্তে পেতে পারে। অন্য দিকে, রেটিং ভালো না হলে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় রেটিং খারাপ হলে বাণিজ্যিকভাবে অন্য দেশের ব্যবসায়িক পরিস্থিতি সেই দেশের ব্যবসায়ী বা ব্যাংকের সাথে লেনদেন করতে দ্বিধায় ভোগে।

বাংলাদেশের ঋণমান কমানোর পথে হাঁটছে মুডিস ইনভেস্টরস
মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান বিএ-থ্রি ও সিনিয়র আনসিকিউরড রেটিংসের মান কমানোর বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করবে। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের মার্চে দেশের ঋণমান নির্ধারণ করেছিল। মাত্র ৯ মাস পরে সংস্থাটি চলতি মাসে রেটিংসের মান কমানোর বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে মুডিস বাংলাদেশের স্বল্পমেয়াদে ইস্যু করা রেটিং নট প্রাইমে নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশের ঋণমান পুনর্মূল্যায়নের কারণ হিসেবে দেশের বহির্লেনদেন পরিস্থিতির অবনতি, বাহ্যিক দুর্বলতা ও সরকারি তারল্য কমার কথা উল্লেখ করেছে। এগুলো দেশের বর্তমান ক্রেডিট রেটিং তথা ঋণমানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না-ও হতে পারে। তারা মনে করছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পর্যাপ্ততার অবনতি রোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশাসনিক দুর্বলতাও রয়েছে। সংস্থাটি মনে করে, বর্ধিত ঋণ বা তহবিল সহায়তা পাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ আইএমএফের সাথে চুক্তি করতে চলেছে। কিন্তু কর্মসূচিসংক্রান্ত শর্তাবলি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বিভিন্ন ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ও সমাজব্যবস্থায় যে প্রভাব পড়তে পারে, তা মোকাবেলায় সরকারি সামর্থ্যে দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষ করে রিজার্ভ কমে যাওয়ার বিষয়টি বড় অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।

মুডিস বলছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুতগতিতে হ্রাস পাচ্ছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে এমনটি হচ্ছে। সেই সাথে খাদ্য ও সারের দাম বাড়ায় সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশ্য স্থানীয় টাকার অবমূল্যায়ন ও কিছু পণ্যের দামের নমনীয়তা মধ্যমেয়াদে বাণিজ্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারে। সংস্থাটি মনে করে, জ্বালানি সঙ্কট স্বল্পমেয়াদে বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি ও তারল্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। মুডিস বলছে, আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর নগণ্য উপস্থিতি ও অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাজারের সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশের সার্বভৌম অর্থায়নের বিকল্পগুলো সীমিত। বিশেষ করে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগও খুব কম যদিও বিদেশী ঋণের রেয়াতযোগ্য প্রকৃতির কারণে তা পরিশোধের সামর্থ্য রয়েছে বাংলাদেশের। তবে ঋণ ব্যবহারে দুর্বলতা আছে; রাজস্ব আয়ের পরিমাণও কম। সব মিলিয়েঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের সামনে। পুনর্মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আইএমএফ কোন কোন শর্তে বাংলাদেশকে ঋণসহায়তা দেয়, তা বিবেচনায় নেবে মুডিস।

সাত ব্যাংকের রেটিং পর্যালোচনা করবে মুডিস
বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের সাতটি ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান পুনর্মূল্যায়ন করার ঘোষণা দিয়েছে মুডিস। দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান পর্যালোচনার সিদ্ধান্তের পর ব্যাংকগুলোর বিষয়ে মুডিসের এ ঘোষণা এলো। ওই ঘোষণায় বলা হয়- দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সার্বভৌম রেটিং ‘বিএ-৩’ থেকে পুনর্মূল্যায়ন করতে এসব ব্যাংকের রেটিং পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এর ব্যাখ্যায় সংস্থাটি জানিয়েছে, বাংলাদেশের সার্বভৌম রেটিংয়ে ব্যাংক খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। ব্যাংকের ঋণ দেয়ার সক্ষমতা সরকারের সক্ষমতাতেও প্রভাব ফেলে।

এর অংশ হিসেবে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড, ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড, এনসিসি ব্যাংক লিমিটেড, প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের ঋণমান পুনর্মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে ওই ঘোষণায়। এর বাইরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের রেটিং এক ধাপ নিচে নামিয়েছে মুডিস। দীর্ঘমেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রার আমানত সংগ্রহে ব্যাংকটির রেটিং ‘বি-২’ থেকে নামিয়ে ‘বি-৩’ করা হয়েছে। আর ব্যাংকটির ঋণ দেয়ার ভিত্তি মূল্যায়ন করে ‘বি-৩’ থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে ‘সিএএ-১’ এ।

সার্বিক আর্থিক অবস্থার ওপর রেটিংস নিতে, এই সাত ব্যাংক মুডিসের সাথে চুক্তিতে একটি নির্দিষ্ট ফি দিয়ে রেটিং নিয়ে থাকে। সেই চুক্তির আলোকেই ব্যাংকগুলোর রেটিংস নিয়মিত পর্যালোচনা করছে মুডিস। বাংলাদেশের সার্বভৌম রেটিং যদি কমে যায়, তাহলে ব্যাংকগুলোর দীর্ঘমেয়াদি রেটিংও কমে যাবে বলে জানিয়েছে মুডিস। সংস্থাটি বলছে, পুনর্মূল্যায়ন করার সময় বিভিন্ন বিষয়ের সাথে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও রয়েছে। পরিস্থিতির উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপগুলোও এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হবে। অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে ইদানীং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে ব্যাংকগুলোর তারল্য প্রবাহ সঙ্কুচিত হয়েছে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে নতুন ঋণপত্র খুলতে কড়াকড়ি আরোপ করার কথা তুলে ধরে মুডিস বলেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া এসব উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য বাড়বে কি না তাও মূল্যায়ন করা হবে। ব্যাংকগুলো যদি তাদের আর্থিক সূচক, বিশেষ করে গুণগত মানের সম্পদ বৃদ্ধি করতে পারে, যদি ভালো মানের ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি করতে পারে, তাতে ব্যাংকগুলোর রেটিং বাড়ার সুযোগও রয়েছে বলে জানিয়েছে মুডিস।

দেশে ভুয়া ক্রেডিট রেটিংয়ের দৌরাত্ম্যের প্রভাব
ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ক্রেডিট রেটিং সনদ বাধ্যতামূলক। এই সুযোগ নিয়ে জমজমাট ব্যবসায় করছে দেশের ক্রেডিট রেটিং কোম্পানিগুলো। বর্তমানে দেশে আটটি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি রয়েছে; ফলে প্রতিযোগিতা অনেক ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অসাধু উপায় অবলম্বন করে থাকে। তাই তো কোনো সক্ষমতা বিবেচনায় না নিয়ে অর্থের বিনিময়ে দেয়া হচ্ছে উচ্চমানের রেটিং। ফলে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান। এভাবেই ভুয়া ক্রেডিট রেটিংয়ের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। কিন্তু ভুয়া রেটিংয়ের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহি করাচ্ছে না রাষ্ট্রের কোনো সংস্থা।

অনেক বড় বড় ঋণখেলাপি কোম্পানি কোনো না কোনো অ্যাজেন্সির মাধ্যমে রেটিং করিয়ে ঋণ পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এসব কোম্পানি যে সম্পদ দেখিয়েছে, তা একেবারে ভুয়া। কিছু কিছু কোম্পানি শত কোটি টাকার ওপরে সম্পদ দেখালেও বাস্তবে তার দাম এক কোটিও নেই। ঋণ আদায়ের জন্য ওইসব কোম্পানির সম্পদ নিলামে ডাকা হলেও কেউ সাড়া দিচ্ছে না। জালিয়াতি করে নেয়া হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ এখন ব্যাংকগুলোর মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে, ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণ এক লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আইএমএফের হিসাবে এই ঋণ দুই লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। ক’য় বছর আগে সংসদে দুই হাজার ঋণখেলাপির তালিকা দিয়েছিল সরকার। এই প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো না কোনো ক্রেডিট রেটিং কোম্পানির কাছ থেকেই রেটিং সনদ নিয়েছে। একই অবস্থা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রেও। আর্থিক অবস্থা দুর্বল থাকা সত্ত্বেও কোম্পানির চাহিদামতো এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে রেটিং করার অভিযোগ উঠেছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে। এরই সামগ্রিক প্রভাব মুডিসের ঋণমান কমানোর উদ্যোগ।

পরিশেষে বলতে হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি সাতটি ব্যাংকের ক্রেডিট রেটিং পর্যালোচনা করে মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস ইঙ্গিত দিয়েছে, একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান বা ক্রেডিট রেটিং পুনর্মূল্যায়ন করতে এসব ব্যাংকের রেটিং পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। বর্ধিত ঋণ সহায়তা বা বর্ধিত তহবিল সহায়তা পাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ আইএমএফের সাথে চুক্তি করতে চলেছে। কিন্তু কর্মসূচি-সংক্রান্ত শর্তাবলি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বিভিন্ন ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ও সমাজব্যবস্থায় যে প্রভাব পড়তে পারে, তা মোকাবেলায় সরকারি সামর্থ্যে দুর্বলতা রয়েছে। একে তো দেশে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কট, তার সাথে ঋণমান কমে গেলে আইএমএফসহ বিদেশী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ঋণ দিলে দেশ শত বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দেউলিয়াত্বের মুখে পড়তে পারে; আসুন, সতর্ক হই।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]