মধুখালীতে দুই ভাইয়ের মৃত্যু : স্কুলে আটকে চেয়ারম্যানও পিটিয়েছিলেন শ্রমিকদের

মারধর

রাত সাড়ে আটটা! স্কুলের একটি কক্ষ ঘিরে হুলুস্থুল চলছে। অনেকে ভেতরের দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণে ব্যস্ত। ফাঁকা কক্ষের ভেতরে উত্তেজিত কয়েকজন পায়চারি করছেন। আর মেঝেতে পড়ে থাকা একজনকে মারধর করছেন। এই মারধরের ঘণ্টা কয়েক পর আহতদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে দুজন মারা যান। নিহত দুজন ছিলেন সহোদর।

১৮ এপ্রিল রাত আটটার দিকে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মারধরের ওই ঘটনা ঘটে। স্কুলের পাশেই থাকা মন্দিরে প্রতিমার গায়ে আগুন লাগানোর অভিযোগে তাঁদের মারধর করা হয়। পরে রটানো হয়, মন্দিরে আগুন দেওয়ার অভিযোগে গণপিটুনিতে দুই সহোদর নিহত।

আসলে সে রাতে গণপিটুনির কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে নিহতদের স্বজনেরা দাবি করেছেন। ২১ এপ্রিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ১৫ ও ৪৩ সেকেন্ডের দুটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, এক ব্যক্তিকে স্কুলের কক্ষে মেঝেতে ফেলে পিটানো হচ্ছে। এ সময় ওই কক্ষে মধুখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ইউপি চেয়ারম্যান শাহ্ আসাদুজ্জামান ও ইউপি সদস্য অজিত কুমার বিশ্বাস উপস্থিত ছিলেন।

নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ, শুরুতে ইউপি চেয়ারম্যান মারধর করেন। পরে মারধর করেন ওই কক্ষে থাকা বাকি ছয় থেকে আটজন। খবর পেয়ে রাত নয়টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মধুখালীর ইউএনও মামনুন আহমেদও ঘটনাস্থলে যান। আহত শ্রমিকদের উদ্ধার করে নিয়ে আসতে চাইলে এলাকাবাসী বাধা দেন এবং পুলিশকে ইটপাটকেল ছোড়েন। পরে র‌্যাব, পুলিশের সদস্যসহ জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং আহতদের উদ্ধার করে ফরিদপুরের শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। রাত সোয়া একটার দিকে নির্মাণশ্রমিক দুই ভাইয়ের একজন আসাদুল (১৭) মারা যায়। রাত আড়াইটার দিকে মারা যান অপর ভাই আশরাফুল (২০)। বাকি দুই শ্রমিক নান্নু মণ্ডল (২১) ও সিরাজ শেখ (৩৫) বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

মন্দিরে আগুন ও দুই ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে সপ্তাহখানেক ধরে উত্তপ্ত মধুখালী। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ‘সর্বস্তরের জনগণের’ ব্যানারে মানববন্ধন করা হয়। ফরিদপুর-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখা হয়। গত মঙ্গলবার রাত থেকে ফরিদপুরে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার ফরিদপুর–১ (মধুখালী, বোয়ালমারী ও আলফাডাঙ্গা) আসনের সংসদ সদস্য এবং মৎস্য ও প্রাণী সম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান মধুখালী যান। তাঁর উপস্থিতিতে সামাজিক সম্প্রীতি কমিটির সভা হয়েছে।

২১ এপ্রিল ভাইরাল হওয়া ভিডিও দুটির সত্যতা যাচাই করতে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক গত মঙ্গলবার পঞ্চপল্লী গ্রামে যান। গ্রামটি গড়াই নদের কাছে মাগুরা, রাজবাড়ী ও ফরিদপুরের সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত। পাঁচটি ছোট ছোট গ্রাম নিয়ে পঞ্চপল্লী গ্রামটির নামকরণ করা হয়েছে। মন্দির ও বিদ্যালয়টি কৃষ্ণনগর গ্রামে একটি বটগাছের দুই পাশে অবস্থিত। গ্রামগুলোতে বৃদ্ধা ও নারী সদস্য ছাড়া আর কাউকে দেখা যায়নি। মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষেরা সবাই গ্রামছাড়া।

স্বজনদের অভিযোগ

নিহত দুই ভাই আশরাফুল ও আসাদুলের বাড়ি মধুখালীর নওপাড়া ইউনিয়নের চোপেরঘাট গ্রামে। তাঁরা নির্মাণশ্রমিকের কাজ করতেন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ চলছিল। সেই কাজেই এসেছিলেন দুই ভাই। অন্যদের সঙ্গে তাঁরা স্কুলের একটি কক্ষে থাকতেন।

এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটার দিকে মন্দিরের কালী প্রতিমার পরনে থাকা শাড়িতে কে বা কারা আগুন দেয়। তবে আগুন কে লাগিয়েছে, সেটা কেউ দেখেনি। কিন্তু দোষ গিয়ে পড়ে পাশের স্কুলে থাকা নির্মাণশ্রমিকদের ওপর।

নিহত সহোদরদের বাবা ও স্বজনদের ভিডিও দুটি দেখালে তাঁরা নিশ্চিত করেন, ঘটনাটি পঞ্চপল্লী গ্রামের। বাবা মো. শাহজাহান খান বলেন, ভিডিওতে দেখা গেছে, ইউপি চেয়ারম্যানও মারধর করেছেন। ইউপি সদস্যসহ ছয় থেকে আটজন মারধরে অংশ নেন। তখন ওই কক্ষের দরজা বন্ধ ছিল। গ্রামের লোকজন ওই কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতর থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনছিলেন।

অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য দুজনই পলাতক থাকায় তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

মামলা ও তদন্ত

মন্দিরে আগুন, দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যা ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে তিনটি মামলা হয়েছে। এর একটির বাদী নিহতদের বাবা, একটির বাদী মন্দিরের পূজারি তপতী মণ্ডল এবং পুলিশ বাদী হয়ে অপর মামলাটি করেছে। জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছেন।

এদিকে মঙ্গলবার রাত নয়টার দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মুর্শেদ আলম বলেছেন, তিন মামলায় এ পর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ভিডিও দুটি তাঁরাও দেখেছেন। ভিডিও দেখার পর ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তবে দুজনই পলাতক আছেন।

prothom alo

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here