ভোটার উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন আওয়ামী লীগের শরিকরাও

এক দশক ধরে সাধারণ ভোটাররা ক্রমেই কেন্দ্রবিমুখ। গত দুই জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি একের পর এক উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কমছে আশঙ্কাজনক হারে। এ পরিস্থিতিতে প্রত্যাশিত নির্বাচন আয়োজনে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন কতটুকু দক্ষতা দেখাতে পারে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ আওয়ামী লীগের জোট শরিকরা।

আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েও অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা। তাদের মতে, বিএনপিসহ আন্দোলনরত সরকারবিরোধী দলগুলো নির্বাচনে আসবে কিনা– এ নিয়ে রয়েছে সংশয়।

তবে কেন্দ্রে সাধারণ ভোটারের উপস্থিতি বাড়ানো গেলে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব বলে তারা মনে করছেন।

১৪ দল নেতারা বলছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষেই রয়েছে তাদের জোটগত অবস্থান। ২০০৫ সালে ১৪ দল গঠনের সময় এ জোটের ২৩ দফার মূল লক্ষ্যই ছিল– অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। সর্বশেষ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে অংশ নিয়েও জোটের একাধিক শরিক এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে ইসিকে তাগিদও দেওয়া হয়েছে।

ক্ষমতাসীন এ জোটে আওয়ামী লীগ ছাড়া ইসির নিবন্ধিত আরও ছয়টি দল রয়েছে। এগুলো হচ্ছে– রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি-জেপি, দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ। সব দলই গত রোববার ইসি আয়োজিত সংলাপে অংশ নিয়েছে। সংলাপে অংশ নেওয়া সব দল অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছে।

অবশ্য নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলে কোনো কোনো দল এটাও বলেছে, বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো এখন এক দফা সরকার পতনের আন্দোলনে রয়েছে। যে আন্দোলন ক্রমেই সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। এ অবস্থায় শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন নিয়ে শঙ্কা যেমন রয়েছে, তেমনি সরকারবিরোধী দলগুলো আগামী নির্বাচনে আসবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য করতে জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

কয়েকজন নেতা অবশ্য এটাও বলেছেন, ২০০৮ সালে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক দল ও শক্তি ক্ষমতায় এসেছে। টানা প্রায় ১৫ বছরে এ সরকার দায়িত্বে থাকলেও নির্বাচন ব্যবস্থা এখনও স্বচ্ছ ও শক্তিশালী হয়নি। বিশেষ করে ২০০৮-পরবর্তী দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনো কোনো মহলের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। এ সময়কালে অনুষ্ঠিত সংসদের উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন নিয়েও এমন প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে অনাগ্রহ সৃষ্টি হওয়ায় অনেক নির্বাচনেই ভোটার উপস্থিতি কমেছে।

তারা বলছেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে সব দলকে নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানও জরুরি। সেটি করা গেলে দেশে-বিদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নির্বাচন ব্যবস্থার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হওয়া সম্ভব। পাশাপাশি পরবর্তী নির্বাচন ও নির্বাচন ব্যবস্থাকেও একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নেওয়া যাবে।

এ ব্যাপারে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া সমকালকে বলেন, নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয় এবং যাতে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে– এমন প্রত্যাশাই তারা ব্যক্ত করেছেন। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে অর্থবহ পদক্ষেপ নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন। তবে যেহেতু রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে, মানুষের মধ্যে কিছুটা শঙ্কা আছে। জাতি এই শঙ্কা থেকে মুক্তি চায়। সেখানে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ সভাপতি আইভি আহমেদ বলেন, আগামী নির্বাচনের দিকে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছে। এ কারণে ইসিরও দায়-দায়িত্ব অন্য নির্বাচনের থেকে বেশি।

একই সঙ্গে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলোর রাজপথে জ্বালাও-পোড়াও এবং সন্ত্রাসের বিরোধিতাও করছে ১৪ দলের শরিকরা। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ থেকে পুলিশ, সাংবাদিক ও প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা, পুলিশ সদস্যকে হত্যা, যানবাহনে অগ্নিসংযোগসহ সন্ত্রাসী ঘটনার প্রতিবাদে এরই মধ্যে ১৪ দলের ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদসহ শরিক দলগুলো প্রতিদিনই রাজপথে মিছিল-সমাবেশ করছে। অন্যদিকে সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের কারণে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশের ক্রমাবনতিতে উদ্বেগ ছড়িয়েছে তাদের মধ্যে।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ১৪ দল একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা একটি জোট। স্বাভাবিকভাবেই তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই চাইছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি বা তার জোট নির্বাচনে আসবে কি আসবে না, সেটি তাদের সিদ্ধান্ত। তবে তারা নির্বাচনে না এলেই যে সে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না– এমন ভাবনাও ঠিক নয়। জনগণ অংশ নিলেই সেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে– এমনটিই তারা মনে করেন।

একই রকম বক্তব্য দিয়ে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, বিএনপি-জামায়াত সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অগ্নিসন্ত্রাস ও নৈরাজ্য মোকাবিলা করেই সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচন সময় মতো এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেই অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।

সমকাল