ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় দেড় বছরে বেড়েছে ৬৩%

 ২০১৩-১৪ অর্থবছর প্রথম ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করা হয়। সে বছর ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা হলেও পরে তা হ্রাস-বৃদ্ধি পায়। যদিও গত কয়েক বছর ভারত থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে আসছে সরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের কয়েকটি কেন্দ্র থেকে এ আমদানি করা হতো। তবে গত অর্থবছর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আদানির ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্র বিদ্যুৎ আমদানি।

এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটির একটি ইউনিট থেকে গত অর্থবছর প্রায় চার মাস (মার্চ-জুন) বিদ্যুৎ আসে। যদিও জুনের শেষ দিকে আদানির কেন্দ্রটির দুটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ আসা শুরু হয়। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল দিতে হয় ডলারে। তবে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়া ও আদানির কেন্দ্রটি যুক্ত হওয়ায় দেশটি থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল প্রতি বছর বাড়ছে। এর মধ্যে দেড় বছরের ব্যবধানে বিদ্যুৎ আমদানির গড় ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৬৩ শতাংশ।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয় ৭৬৪ কোটি ৪৩ লাখ ৫৫ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য ব্যয় হয় চার হাজার ৬৭৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। এতে ইউনিটপ্রতি আমদানি ব্যয় পড়ে গড়ে ছয় টাকা ১১ পয়সা। এর মধ্যে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত এনভিভিএন (বিদ্যুৎ ভ্যাপার নিগম লিমিটেড) ২৫০ মেগাওয়াট আমদানির গড় ব্যয় ছিল তিন টাকা ২৩ পয়সা ও এনভিভিএন ৩০০ মেগাওয়াট আমদানির গড় ব্যয় পাঁচ টাকা ৯৬ পয়সা। এছাড়া এনভিভিএন ত্রিপুরা কেন্দ্র থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির গড় ব্যয় ছিল সাত টাকা ৯৫ পয়সা।

এর বাইরে দেশটির বেসরকারি খাতের সেম্বকর্প ইন্ডিয়া থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এতে গড় ব্যয় পড়ে সাত টাকা ২৬ পয়সা এবং পিটিসি থেকে ২০০ মেগাওয়াট আমদানির গড় ব্যয় ছিল সাত টাকা ৪৫ পয়সা।

প্রসঙ্গত, ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এনটিপিসির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এনভিভিএন থেকে দুই ফেজে যথাক্রমে ২৫০ ও ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। এ দুই চুক্তির মেয়াদ ২৫ বছর। এছাড়া সেম্বকর্প ইন্ডিয়া থেকে ২৫০ মেগাওয়াট, পিটিসি থেকে ২০০ মেগাওয়াট ও

এনভিভিএন ত্রিপুরা থেকে আরও ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এর মধ্যে সেম্বকর্র্প ও পিটিসির চুক্তির মেয়াদ ১৫ বছর করে আর ত্রিপুরার চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করা হয়।

২০১৪ সালে প্রথম জিটুজি ভিত্তিতে এনভিভিএনের ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। এ চুক্তির মেয়াদ ২০৩৯ সালে শেষ হবে। আর এনভিভিএনের বাকি ৩০০ মেগওয়াট, পিটিসির ২০০ ও সেম্বকপের ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা হয় ২০১৮ সালে। এ তিন চুক্তি মেয়াদ শেষ হবে ২০৩৩ সালে। আর এনভিভিএন ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানিতে চুক্তি করা হয় ২০১৬ সালে। পাঁচ বছর মেয়াদি এ চুক্তির মেয়াদ ২০২১ সালে শেষ হলে তা আরও পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন করা হয়।

পিডিবির তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয় এক হাজার ৫১ কোটি ৫৪ লাখ ৬৮ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য ব্যয় হয় ৯ হাজার ২২৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এতে ইউনিটপ্রতি আমদানি ব্যয় পড়ে গড়ে আট টাকা ৭৭ পয়সা। অর্থাৎ গত অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বেড়েছে ৩৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ ও আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৯৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আদানির বিল যুক্ত হওয়া এবং ডলারের দর বৃদ্ধি এর অন্যতম কারণ।

বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয়ের মধ্যে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত এনভিভিএন ২৫০ মেগাওয়াট আমদানিতে গড় ব্যয় ছিল চার টাকা ২২ পয়সা এবং এনভিভিএন ৩০০ মেগাওয়াট আমদানিতে গড় ব্যয় সাত টাকা ১৫ পয়সা। এছাড়া এনভিভিএন ত্রিপুরা কেন্দ্র থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির গড় ব্যয় আট টাকা ৪৫ পয়সা। এর বাইরে দেশটির সেম্বকর্প ইন্ডিয়া থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানিতে গড় ব্যয় ছিল ৯ টাকা ৯৫ পয়সা এবং পিটিসি থেকে ২০০ মেগাওয়াট আমদানির গড় ব্যয় ৯ টাকা ৫৫ পয়সা। অর্থাৎ এ পাঁচ কেন্দ্রের ভারিত গড় ব্যয় ছিল সাত টাকা ৮৩ পয়সা আর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির গড় ব্যয় পড়ে ১৪ টাকা ০২ পয়সা।

জানতে চাইলে পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কয়লাচালিত। আর গত অর্থবছর জানুয়ারি পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম ছিল রেকর্ড সর্বোচ্চ। পরে তা কমতে শুরু করে। তাই কয়লার দামের প্রভাবে আদানির বিদ্যুৎ কেনার ব্যয় বেশি পড়েছে। তবে চলতি অর্থবছর কয়লার দাম কম থাকায় জ্বালানি ব্যয় কমছে। এতে আদানির বিদ্যুৎ কেনায় গড় ব্যয় কম পড়বে। আর ভারতের অন্য যেসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয় সেগুলো গ্যাসচালিত। তাই ওইসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলকভাবে আদানির চেয়ে অনেক কম।

এদিকে চলতি অর্থবছর প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছে ৮৩৮ কোটি ৬০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য ব্যয় হয়েছে ৯ হাজার ৩০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় পড়ে গড়ে ১০ টাকা ৭৭ পয়সা। এর মধ্যে আদানির কেন্দ্রটির গড় ব্যয় ছিল ১৩ টাকা ৫৫ পয়সা এবং অন্য কেন্দ্রগুলোর ভারিত গড় ব্যয় আট টাকা ২৪ পয়সা। এ হিসাবে দেড় বছরে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির গড় ব্যয় বেড়েছে ৬২ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

উল্লেখ্য, আদানির গড্ডা কেন্দ্রটি থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে প্রতি বছর কেন্দ্রটির সক্ষমতার কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতেই হবে। তবে বিদ্যুৎ যে পরিমাণই কেনা হোক মাসে আদানিকে তিন কোটি ৯৫ লাখ ৯৭ হাজার ৮৫৭ ডলার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতেই হবে।

আদানির গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির এক বছরের বিলের জন্য এক দশমিক ১২ বিলিয়ন বা ১১২ কোটি ১৩ লাখ ৭৬ হাজার ৪১৫ ডলার পরিশোধে অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত এক বছর কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল পরিশোধে এ ডলার ব্যবহার করা হবে। সোনালী ব্যাংকের ওয়াপদা শাখার মাধ্যমে এ বিল পরিশোধে এরই মধ্যে এলসি খোলা হয়েছে।

এতে দেখা যায়, এক বছরে আদানি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে জ্বালানি বিল দেয়া হবে ৬৬ কোটি ৪৭ লাখ ৩৫ হাজার ২৯২ ডলার। আর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হবে ৪৫ কোটি ৬৬ লাখ ৪১ হাজার ১২৫ ডলার। আদানির বিদ্যুৎ কিনতে প্রতি বছর এক বিলিয়ন ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

sharebiz