ভারতের নিষেধাজ্ঞা যেভাবে গরু উৎপাদনে বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হলো


২০১৫ সালের ১ এপ্রিল ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের এক নির্দেশনার পর সেই দেশ থেকে বাংলাদেশে গবাদি পশু রফতানি বন্ধ হয়ে যায়।

নিষেধাজ্ঞার বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় কোটি গবাদি পশু আসত, যার মূল্য প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

এত বড় মার্কেটে হঠাৎ নিষেধাজ্ঞায় নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরাও।এর আগেই গোশতের বাজারে আগুন লেগেছিল।

এরপর বাংলাদেশে গবাদি পশু, বিশেষ করে গরুর গোশতের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা জেগেছিল।

তবে সে আশঙ্কা সত্যি হওয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশ গোশতের গরু উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে গেছে বলে দাবি করছে সরকার এবং খামারিরা।

এমনকি ২০১৫ সালের সেই নিষেধাজ্ঞার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা: শেখ আজিজুর রহমান ডয়চে ভেলের সাথে আলাপে ভারত সরকারকে বরং ধন্যবাদই দিয়েছেন।

তার মতে, ২০১৫ সালে ভারত সেই সিদ্ধান্ত না নিলে বাংলাদেশ গোশতের জোগানে স্বনির্ভর হতে পারতো না।

তিনি বলেন, মোদি সরকার নিষেধাজ্ঞা না দিলে আমরা বুঝতে পারতাম না, আমাদের মধ্যে কতটা উদ্ভাবনী ক্ষমতা লুকিয়ে আছে। আমাদের খামারিরা, কৃষকরা দিনরাত পরিশ্রম করে সেই ঘাটতিটা পুষিয়ে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমরা প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম গরুর গোশতের কেজি এক হাজার টাকা হয়ে যাবে। তা কিন্তু হয়নি। (গরুর গোশতের দামে) আমরা এখন মোটামুটি সহনীয় মাত্রায় আছি। (পশুর) খাবারের দামটা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে আরো সহনীয় মাত্রায় যেতে পারতাম।

ডাচ ডেইরির গল্প
২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মুন্সীগঞ্জের ডাচ ডেইরি লিমিটেড বাংলাদেশের সর্বাধুনিক খামারগুলোর একটি। এখন এই খামারে গরু ছাড়াও ভেড়া এবং ছাগল রয়েছে। এবার প্রায় ৩০০টি গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়। তবে মনে রাখতে হবে, ডাচ ডেইরি মূলত দুধের খামার।

এই খামার কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা দুই ধরনের গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করেন। প্রথমত, খামারে জন্ম নেয়া ষাঁড়, বাছুরগুলো বড় করে কোরবানির সময়ে বিক্রি করেন। দ্বিতীয়ত, দেশী বাজার থেকেও কিছু গরু সংগ্রহ করে তারা লালনপালন করে থাকেন।

বাংলাদেশে কি আসলেই গবাদি উৎপাদনে বিপ্লব হয়ে গেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে এই খামারের সিইও গিয়াস আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘যদি গোশতের চাহিদা পূরণের দিক থেকে দেখেন, তাহলে বিপ্লব হয়েছে বলা যাবে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সারা বছর যত পশু জবাই হয়, প্রায় সমান সংখ্যক পশু জবাই হয় কোরবানির সময়ে। এক সময় কোরবানির বাজারসহ সারা বছরের বাজারের বড় একটা অংশ ভারত থেকে আসতো।’

তার মতে, ‘এখন কোরবানির সময় ভারত থেকে গরু আসে না বললেই চলে। সারা বছর যা আসে, তার পরিমাণও খুবই কম।’

তিনি বলেন, ‘আমরা নিজেদের পশু দিয়েই চাহিদা মেটাতে পারছি। এই দিক থেকে ভাবলে অবশ্যই বিপ্লব হয়েছে।’

তবে গিয়াস আহমেদের মতে, দুধের উৎপাদনের দিকে তাকালে কিন্তু সেটা মনে হবে না। সেখানে পরিস্থিতি পাল্টাতে উন্নত জাতের গাভী প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তার মতে, উন্নত জাত এবং সঠিক ব্যবস্থাপনাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হলে বাংলাদেশে বর্তমানে যে সংখ্যক গাভী রয়েছে, সেই সংখ্যার গাভী দিয়েই ৮-৯ গুণ বেশি দুধ উৎপাদন সম্ভব। গোশতের গরুর ক্ষেত্রে একই পদক্ষেপ নিলে গোশত উৎপাদন বাড়বে ২-৩ গুণ।

২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে গাভী এনে যাত্রা শুরু করেছিল ডাচ ডেইরি। তিনি জানান, ব্রাজিল থেকে গাভী আনার জন্যও সরকার থেকে অনুমোদন নিয়ে রেখেছেন তারা। করোনা না থাকলে এতদিনে সেই গাভী চলে আসতো।

তিন বলেন, ‘এখনো কাজ করার মতো অনেক জায়গা রয়েছে। তবে সরকারকে পলিসি পরিবর্তন করতে হবে এবং আরো নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে।’

শহরের বুকে সম্রাট ডেইরি
ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে সম্রাট ডেইরি ফার্ম গড়ে তুলেছেন এক সময়কার প্রবাসী জাকির হোসেন। চার কাঠার উপরে নির্মিত চারতলা একটি ভবনে তিনি গড়ে তুলেছেন গরুর খামার। বহুতল ভবনে খামার নির্মাণের এই ঘটনা চমক সৃষ্টি করে। অনেকেই এই খামার দেখতেও যান।

কিছুদিন আগেও তার খামারে আড়াই শ’ গরু ছিল। বিক্রি করে দেয়ার পর এখন ৪৫টি দুধের গরু রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘সিঙ্গাপুর থাকার সময় দেখেছি, বহুতল ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে গাড়ি পার্কিং হয়, ছাদের উপরে বাগান হয়। এসব দেখে আমার মনে হয়েছে, খামার কেন হবে না? দেশে ফিরে তাই আমি এই খামারটি করেছি।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ফ্লোরে গরু আনার পূর্বে বালু দিয়েছি। সেটার উপর আরেকটা ঢালাই দিয়েছি। এমন ব্যবস্থা করেছি, যাতে কোনোভাবেই পানি ছাদ স্পর্শ না করে।’

যেভাবে ভারত থেকে গরু আসতো
ভারত থেকে বাংলাদেশে বৈধ পণ্যের মতো গরু আনার সুযোগ কখনোই ছিল না। গরু আসতো অনানুষ্ঠানিকভাবে।

সিপিডির করা ‘বাংলাদেশ’শ ফরমাল অ্যান্ড ইনফর্মাল এগ্রিকালচারাল ট্রেড উইথ সার্ক কান্ট্রিজ’ শীর্ষক এক পেপারে বলা হয়, অনেকের মতে, বাংলাদেশ ভারতের অনানুষ্ঠানিক এই বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার।

ভারত থেকে গরু বাংলাদেশে ঢোকার পর দেখানো হতো, গরুগুলো মালিকানাহীনভাবে সীমান্ত এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এরপরের ধাপে সীমান্তরক্ষীরা গরুগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে আসতো। সেখান থেকে ৫০০ টাকা ফি দিয়ে গরুর প্রকৃত মালিকরাই গিয়ে মালিকানা দাবি করতো এবং গরু নিয়ে আসতো। এই পদ্ধতিটিই মোটামুটি সবচেয়ে স্বীকৃত ছিল।

এর বাইরে বাঁশ-রশি দিয়ে একটা যন্ত্র তৈরি করতো চোরাকারবারিরা। সেটির সাহায্যে এক পাশ থেকে অন্যপাশে কাঁটাতারের বেড়ার উপর দিয়ে গরু নিয়ে যেতো তারা। তাছাড়া নদী-জঙ্গলে ঢাকা এলাকায় সবার চোখ এড়িয়েও গরু আসতো বাংলাদেশে।

মেহেরপুরের সাংবাদিক তুহিন আরণ্য বলেন, ‘এক সময় ভারত থেকে গরু আনাই ছিল সীমান্ত এলাকার বড় ব্যবসা। সীমান্তের অনেক মানুষ সারাদিন এই কাজে ব্যস্ত থাকতো।’