দেশের আমদানীকৃত চালের প্রায় ৭৩ শতাংশ আসে ভারত থেকে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের আগস্টের শেষ দিক পর্যন্ত কয়েক দফায় পণ্যটি রফতানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে দেশটির সরকার। এর প্রভাবে চালের আন্তর্জাতিক বাজার অস্থিতিশীল হলেও ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। দেশে পণ্যটির বাজারদর এখনো স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে। দেশে এখন চালের মজুদও পর্যাপ্ত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
চালকল মালিক, পাইকারি ও খুচরা চাল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত কয়েক মাসে চালের বিক্রি কমেছে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অন্তত ১৫-২০ শতাংশ। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যয়ভার বেড়েছে সাধারণ মানুষের, যার প্রভাবে ভোগ ও চাহিদা কমছে পণ্যটির। বিষয়গুলো দেশে চালের বাজার অস্থিতিশীল না হয়ে ওঠার পেছনে বড় প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে।
চলতি বছরের মাঝামাঝি থেকেই বিশ্ববাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্বের সবচেয়ে বড় চাল রফতানিকারক দেশ ভারত। গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর ভাঙা চাল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটি। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে গত ২০ জুলাই থেকে সব ধরনের নন-বাসমতী চাল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারত সরকার। এছাড়া গত ৫ আগস্ট সিদ্ধ চাল রফতানিতে ২০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়।
এসব পদক্ষেপে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বাড়লেও বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়েনি। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, গত ২০ জুলাই দেশের বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৮-৫২ টাকা, মাঝারি চাল ৫০-৫৫ ও সরু চাল ৬০-৭৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এর পর থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত চালের দাম প্রায় একই ছিল।
তবে গত এক সপ্তাহে পাইকারি বাজারে বিভিন্ন জাতের চাল কেজিতে ২-৪ টাকা করে বেড়েছে। বর্তমানে রাজধানীর পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ব্রি ২৮ ৫০ টাকা, নাজিরশাইল ৭৬, মিনিকেট ৬৪, গুটি স্বর্ণা ৪৮ ও বাসমতী চাল ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রি ২৮ কেজিতে ৪ টাকা, স্বর্ণা কেজিতে ৩ টাকা ও মিনিকেট ২ টাকা করে বেড়েছে। এজন্য প্রধানত মিলারদের দায়ী করছেন কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো আগের চেয়ে বিক্রি কমলেও ধান কম থাকার অজুহাতে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছেন মিলাররা। মিল পর্যায়েই ধরনভেদে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে বস্তায় ১০০-২০০ টাকা।
নীতিনির্ধারকরা বলছেন, মজুদ পর্যাপ্ত থাকায় বাংলাদেশে এখন চাল আমদানির কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার গতকাল রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমাদের দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ বছর বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে হয়নি। সামনের দিনগুলোয় আমরা বিদেশে চাল রফতানি করা যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখছি। এ বছর বোরো ধান ভালো হয়েছিল। বোরোর মতো আমনেরও বাম্পার ফলনের আশা করা যাচ্ছে। দেশে খাদ্য সংকট নেই। তবে ব্যবসায়ীদের সচেতন ও ভোক্তাবান্ধব হতে হবে। দিনাজপুরের চালের দাম ঢাকায় এসে অনেক বেড়ে যায়। এ প্রবণতা ছাড়তে হবে।’
দেশের বিভিন্ন স্থানের চালকলের মালিক, পাইকারি ও খুচরা চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চালের কেনাবেচা এখন স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১৫-২০ শতাংশ কমেছে। আর এজন্য বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন প্রধানত মূল্যস্ফীতিকে।
সাবেক খাদ্য সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মানুষের আয় খুব বেশি না বাড়লেও ব্যয় সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেশি বেড়েছে। স্বভাবতই এসব পরিস্থিতিতে মানুষ ভোগ কমিয়ে দেয়। কারণ ভোগ নির্ভর করে আয়ের ওপর। স্বল্প আয়ের যারা তারা কম খেয়ে থাকতে পারেন। মোটা চাল তো খুব বেশি মানুষ খায় না। সেটিও ৫০ টাকার বেশি। ডলার সংকটের কারণে সরকার চাইবে চাল আমদানি না করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার। কিন্তু এর কারণে দেশের বাজারে চালের দাম বেড়ে যেতে পারে। আর দাম বাড়লে ভোগ আরো কমে যাবে।’
বাংলাদেশে চালের সবচেয়ে বেশি সরবরাহ আসে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলভুক্ত নওগাঁ জেলা থেকে। জেলাটির চালকল মালিকরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে চাল বিক্রি কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। এখান থেকে গত বছর ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে দৈনিক গড়ে দেড় হাজার টন চাল সরবরাহ করা হয়েছে। তবে বর্তমানে ওই সব মোকামে চাহিদা একেবারেই কম। দৈনিক সরবরাহ নেমে এসেছে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ টনে। গত বছরের অক্টোবরেও জেলার মিলগুলো সচল ছিল। চাহিদাও ছিল বেশ ভালো। কিন্তু বর্তমানে পুরোপুরি ভিন্ন পরিস্থিতি। চাহিদা কমেছে। বেশির ভাগ সময়ই মিলগুলোকে বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
জেলার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিল পর্যায়ের পাশাপাশি খুচরা ও পাইকারিতেও বিক্রি কমেছে। নওগাঁর পৌর চাল বাজারের মালশন রাইস সেন্টারের খুচরা চাল ব্যবসায়ী মানিক প্রামাণিক বলেন, ‘অনেক ক্রেতা ছিল যারা কখনো ১ বস্তার নিচে চাল কেনেনি। এখন তারাও ৫-১০ কেজি করে চাল কিনছেন। প্রায় তিন মাস ধরে মোকামগুলোর বেচাবিক্রিতে মন্দা চলছে। এখন দিনে ১ হাজার টাকার চাল বিক্রি করাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে।’
চাল বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে নওগাঁ ধান্য-চাউল আড়ৎদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা চন্দন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে মূল্যস্ফীতির প্রভাবে ক্রেতারা এখন অর্থ সাশ্রয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। দৈনন্দিন বাজার তালিকাও সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বিপদে পড়লে মানুষ খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনে। বাজারে এখন এটিই দেখা যাচ্ছে। ক্রেতারা চাল কেনা কমিয়েছেন। আবার সরকারও টিসিবিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির চাল বিতরণ অব্যাহত রেখেছে। তিন মাসের চাল ভোক্তাদের একবারে দেয়া হয়েছে। আগে এ অঞ্চলের মানুষ মোটা চাল না খেলেও এখন তারা এটিতেও অভ্যস্ত হচ্ছে।’
নওগাঁর মতো একই চিত্র দেশের অন্যান্য জেলায়ও। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বছরের এ সময় চালের বিক্রি এমনিতেই একটু কম থাকে। কিন্তু এবার কোথাও কোথাও তা প্রায় এক-চতুর্থাংশও কমেছে।
কালুরঘাট এলাকার মেসার্স মালতী স্টোরের ব্যবস্থাপক সঞ্জয় দেবনাথ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বছরের এ সময়ে এমনিতেই চাল বিক্রি কমে যায়। এর সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়াসহ আরো কিছু কারণে বিক্রি অনেকটাই পড়ে গেছে। সামনের দিনগুলোয় দাম কমলে ও শীত মৌসুম এলে চালের বেচাকেনা আবার বাড়তে পারে।’
দেশের মোটা চালের অন্যতম উৎস রংপুর। জেলাটিতে ২০২২-২৩ মৌসুমে ১১ লাখ ৬৭ হাজার ৪৫ টন চাল উৎপাদন হয়। এখানকার চালকল মালিকরাও বলছেন, চাল বিক্রি আগের চেয়ে কমেছে। বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় মিল মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং রংপুর মহানগর মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সামসুল আলম বাবু বলেন, ‘ধানের ভালো ফলন ও সরকারের বিভিন্ন সহায়তা কর্মসূচির কারণে চালের বাজার স্থিতিশীল আছে। যদিও মিলগুলো থেকে চালের সরবরাহ আগের তুলনায় কমেছে।’
একই কথা বলছেন দিনাজপুরের হিলি, গাইবান্ধাসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানের বড় চাল সরবরাহকারী ব্যবসায়ীদের প্রায় সবাই। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, বাজারে এখন চালের সরবরাহ পর্যাপ্ত। আবার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণেও ক্রেতারা এখন চাল কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। এর সঙ্গে সঙ্গে সরকারি বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় চাল বিতরণ বেড়ে যাওয়ার কথাও বলেছেন কেউ কেউ। যদিও খাদ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সরকারি পর্যায়েও চাল বিতরণ কমেছে। চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত অর্থাৎ একই সময়ে সরকারিভাবে মোট চাল বিতরণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৪৪ টন। যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারিভাবে চাল বিতরণ করা হয়েছিল ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৭৪৩ টন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, সরকার টিসিবির মাধ্যমে ওএমএসের চাল ৩০ টাকা দরে বিক্রি শুরু করেছে। আগে যেখানে এক মাসের চাল বিক্রি করা হতো, সেখানে দুই মাসের চাল একসঙ্গে দেয়া হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সরকার এ বছর টিসিবির মাধ্যমে মাসিক চাল বিতরণের পরিমাণ বাড়িয়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের সরবরাহ, বণ্টন ও বিপণন বিভাগের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘টিসিবির মাধ্যমে এখন আমরা প্রতি মাসে আরো ৫০ হাজার টন চাল বেশি বিতরণ করছি। আমাদের বিতরণ কর্মসূচি আগের চেয়ে বিস্তৃত হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর থেকে আমন সংগ্রহ শুরু হবে। এর আগ পর্যন্ত আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তাতে দশ লাখ টনের বেশি চাল মজুদ থাকবে। এরপর চলতি আমন মৌসুমে দুই লাখ টন ধান ও পাঁচ লাখ টন চাল সংগ্রহ করা হবে। চাল আমদানির আপাতত কোনো প্রয়োজন নেই।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ কোটি ১৭ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে আউশ মৌসুমে ২৯ লাখ ১ হাজার টন, আমন মৌসুমে ১ কোটি ৭০ লাখ টন এবং বোরো মৌসুমে ২ কোটি ১৮ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। চাল উৎপাদনের তথ্য পরবর্তী সময়ে ডিএইর সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ডিএইর উৎপাদনের পরিসংখ্যান সাধারণত বিবিএসের তথ্যে এসে অনেকটাই কমে যেতে দেখা যায়। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে আউশে ২৯ লাখ টন ও আমনে ১ কোটি ৫৪ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। বোরো মৌসুমের উৎপাদনের তথ্য এখনো সমন্বয় করেনি বিবিএস। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট চাল উৎপাদন হয়েছিল ৩ কোটি ৮৩ লাখ টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিগত বছরগুলোর তুলনায় আমাদের উৎপাদন অনেক বেশি বেড়েছে। সব ঠিক থাকলে আর চাল আমদানি করার প্রয়োজন হবে না। মাঠে আমন রয়েছে। এখন পর্যন্ত উৎপাদন আগের চেয়েও ভালো হবে বলে বোঝা যাচ্ছে। বিগত বোরো ও আমনের উৎপাদনও ভালো হয়েছিল। আমাদের অনেক উচ্চফলনশীল জাত এসেছে। সেগুলো কৃষকরা আবাদ করা বাড়িয়েছেন। এতে সার্বিকভাবে উৎপাদন বেড়েছে।’
চালের বাজারে বেচাবিক্রি কমে যাওয়ার পেছনে খাদ্য মূল্যস্ফীতির বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত আগস্টে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে, যা গত সাড়ে ১১ বছরের সর্বোচ্চ। সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মানুষের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বাড়বে এটা স্বাভাবিক। কারণ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। ফলে মানুষকে নানাভাবে কাটছাঁট করে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে। এ কারণে চালের চাহিদা কিছুটা কমে যাবে। আবার সরকারি-বেসরকারি মজুদও যথেষ্ট রয়েছে। যদি মজুদ কম থাকত তাহলে দাম বাড়ার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যেত। ব্যবসায়ীরা তো সুযোগের হাতছাড়া করতে চান না। মানুষ এখন সবকিছুই কম কম কিনছে।’
বনিক বার্তা