ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় হাতে নেওয়া রেলের ৫ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে প্রকল্পগুলোর কাজ বন্ধ। প্রকল্পের ভারতীয় ঠিকাদার ও কর্মীরা ওই সময় বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার পর আর ফেরেননি।
২০১০ সালে এলওসির আওতায় ছয়টি প্রকল্প হাতে নেয় রেল মন্ত্রণালয়। প্রকল্প ছয়টি হলো– বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েলগেজ রেলপথ, কনস্ট্রাকশন অব ডাবল লাইন রেলওয়ে ট্রাক অন খুলনা-দর্শনা জংশন সেকশন, ঢাকা-টঙ্গী-জয়েদবপুর সেকশনের তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ, কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন, খুলনা থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ এবং আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ। এর মধ্যে কেবল আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। অনিশ্চয়তায় পড়েছে বাকি পাঁচ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ। অর্থছাড় না হওয়া, সরঞ্জাম ক্রয়সহ নানা জটিলতায় প্রকল্পগুলোর কাজ এগোয়নি। এমনকি তিনটি প্রকল্পের কাজ শুরুই হয়নি। এমন অবস্থায় ভারত আসলে ঋণের অর্থ দেবে কিনা– তা নিশ্চিত হতে চায় সরকার। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) নির্দেশ দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। ইআরডি বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বলে জানা গেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, মূলত রাজনৈতিক কারণে ওই সময় বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত। বাস্তবে ঋণ দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থ তাদের নেই। তিনি জানান, এলওসির শর্ত ছিল প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ সরঞ্জাম ও সেবা ভারত থেকে নিতে হবে। কিন্তু অনেক সরঞ্জাম ভারতে পাওয়া যায় না অথবা পাওয়া গেলেও সেগুলোর মান ভালো নয়। তাই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতিযোগিতামূলক দরে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে চায় বাংলাদেশ। এসব নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে প্রকল্পের কাজে অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনায় বাংলাদেশ-ভারতের প্রতিনিধিদের নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি রয়েছে। ওই কমিটির শেষ বৈঠক হয় গত বছর। জানা গেছে, বৈঠকে ভারত থেকে ৫০ শতাংশ সরঞ্জাম কেনার পর বাকিটা অন্য দেশ থেকে নেওয়ার প্রস্তাব দেন ভারতীয় প্রতিনিধিরা। এলওসির আরেকটি শর্ত হলো– প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ, দরপত্র প্রণয়ন, নকশা তৈরি ও দরপত্র চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিকল্পনা কমিশনের ওই কর্মকর্তা জানান, সরকার পরিবর্তনের সময় চলে যাওয়া ভারতীয় কিছু কর্মী সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তা সমস্যার কথা বলে দেশটির হাইকমিশন তাদের ফেরত পাঠিয়েছে।
রেল মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানান, এলওসির আওতায় হাতে নেওয়া রেলের প্রকল্প বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে পরে কী হবে, তা বলা যাচ্ছে না। প্রকল্পে ভারতীয় কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
গত ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার সঙ্গে বৈঠকের পর অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এলওসির প্রকল্পগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের স্বার্থ বিবেচনায় সেগুলো হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পগুলো বন্ধ হবে না, কাজ চলবে। শুধু তাই নয়, উভয় দেশের স্বার্থ বিবেচনায় আরও প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।’ ভারতীয় হাইকমিশনারও বলেন, ‘দুই পক্ষের পারস্পরিক সম্মতিতে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হবে। ভারত এ ব্যাপারে ইতিবাচক।’
দেওয়ার কথা সাড়ে সাতশ কোটি ডলার
২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় বাংলাদেশকে এলওসির আওতায় সাড়ে সাতশ কোটি ডলারের বেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত। তিন ধাপে এই ঋণ দেওয়ার কথা। ২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় এলওসি-২ এর আওতায় ২০০ কোটি ডলার ঋণের ব্যাপারে সমঝোতা চুক্তি সই হয়। ২০১৭ সালে শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় এলওসি-৩ এর আওতায় ৪৫০ কোটি ডলার দেওয়ার ঘোষণা আসে। ঋণের সুদহার ধরা হয় ১ শতাংশ, প্রতিশ্রুতি ফি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। খেলাপি হলে ২ শতাংশ হারে সুদ ধার্য রয়েছে। ৫ বছরের রেয়াতকালসহ ২০ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ইআরডির হিসাব অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত এলওসির আওতায় ছাড় হয়েছে ১৮১ কোটি ডলার।
যেসব প্রকল্প নিয়ে অনিশ্চয়তা
পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্রে জানা গেছে, এলওসির আওতায় রেলের প্রকল্পগুলোর মধ্যে ‘বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েলগেজ রেলপথ’ প্রকল্পের মেয়াদ গত বছরের জুনে শেষ হয়েছে। প্রকল্পের কাজই শুরু হয়নি। এ অবস্থায় ২০২৬ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পের ৩ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা আসার কথা এলওসি থেকে। বাকি টাকার জোগান দেবে সরকার।
চুক্তি অনুযায়ী, প্রকল্পের ঠিকাদার নির্বাচন করে ভারতের এক্সিম ব্যাংক। ব্যাংকটি ঠিকাদারের সংক্ষিপ্ত তালিকা দেওয়ার পর দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু ‘বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েলগেজ রেলপথ’ প্রকল্পের ঠিকাদারের সংক্ষিপ্ত তালিকা রেল মন্ত্রণালয় এখনও পায়নি। গত বছরের অক্টোবরে এ ব্যাপারে ভারতকে চিঠি দেওয়া হয়; কিন্তু এখন পর্যন্ত জবাব মেলেনি।
এলওসির আওতায় হাতে নেওয়া ‘কনস্ট্রাকশন অব ডাবল লাইন রেলওয়ে ট্রাক অন খুলনা-দর্শনা জংশন সেকশন’ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। অথচ এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়নি। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা এলওসি থেকে আসার কথা। বাকি ৮১৭ কোটি টাকা সরকারের। প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৬ সাল পর্যন্ত।
‘পার্বতীপুর থেকে কাউনিয়া মিটারগেজ লাইন ডুয়েলগেজে রূপান্তর’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের প্রথম দিন। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনও প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। ৫৭ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে এলওসি থেকে আসার কথা ১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। বাকিটা সরকারের তহবিল থেকে খরচ হবে।
অন্যদিকে বহুদিন ধরে চলছে ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনের তৃতীয়-চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ এবং কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ। এর মধ্যে প্রথমটির কাজ শুরু হয় ২০১২ সালের জুলাইয়ে, যা এখনও শেষ হয়নি। দুই দফা সংশোধনের পর ২০২৭ সালের জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। ৩ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পে এলওসি থেকে পাওয়ার কথা ২ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। বাকি ৫২১ কোটি টাকা সরকারের। তবে চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে এই প্রকল্পে।
প্রকল্প পরিচালক নাজনীন আরা কেয়া সমকালকে বলেন, ‘প্রকল্পে নতুন কিছু অঙ্গ সংযোজন হয় গত বছর। ৭১ কিলোমিটারের বদলে লাইনের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে ১৩৭ কিলোমিটার করা হয়। এ ব্যাপারে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের মতামত চাওয়া হয় গত বছরের সেপ্টেম্বরে। কিন্তু এখনও তারা হ্যাঁ কিংবা না বলেনি।’
কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১১ সালের জুলাইয়ে। ১৩ বছরেও প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়নি। ৬৭৯ কোটি টাকার প্রকল্পে ৫৫৬ কোটি টাকা এলওসি থেকে আসার কথা। বাকি ১২৩ কোটি টাকা দেবে সরকার। চলতি এডিপিতে প্রকল্পটিতে ২৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
তবে খুলনা থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ মোটামুটি ভালো এগিয়েছে। ২০১০ সালে শুরু হয় প্রকল্পটির কাজ। তিন দফা সংশোধনীর পর আগামী বছরের জুনে প্রকল্পটির বাকি কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। ৪ হাজার ২২৬ কোটি টাকার এই প্রকল্পে এলওসি থেকে আসার কথা ২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে প্রকল্পটিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৫ কোটি টাকা।
আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ শেষ হয় গত বছরের নভেম্বরে। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছিল। ব্যয় হয় ৪৭৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এর মধ্যে এলওসি থেকে এসেছে ৪২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
রেল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্প ছাড়া বাকি পাঁচটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কারণ, কবে টাকা পাওয়া যাবে, কবে ভারতীয় কর্মীরা আসবেন, কবে ঠিকাদারের তালিকা পাওয়া যাবে– সবকিছুই এখন অনিশ্চিত।
samakal