ব্যাংক এমডিদের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরো বিধিনিষেধ আরোপ

এখন থেকে ৪৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কেউ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হতে পারবেন না। এমডি নিযুক্তির দুই মাস আগে প্রয়োজনীয় নথিপত্রসহ নিয়োগ প্রস্তাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত সময় ও স্থানে এমডি পদে মনোনীত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার হবে। ইনক্রিমেন্ট, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি সুবিধা, নববর্ষ ভাতা, ছুটি নগদায়নসহ অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা ব্যাংক এমডিরা নিতে পারবেন না। চিকিৎসাসহ যেকোনো প্রয়োজনে দেশের বাইরে যেতে হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। এমন সব বিধান রেখে এমডি পদে নিয়োগের নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

নীতিমালায় দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর এমডি বা শীর্ষ নির্বাহী পদে নিয়োগ ও তার দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি’ বিভাগ থেকে গতকাল নীতিমালাটি জারি করা হয়। এতে এমডি পদে নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগের যোগ্যতা ও উপযুক্ততা, বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য আর্থিক সুবিধা, বিদেশ ভ্রমণ, এমডি পদ থেকে অব্যাহতি বা অপসারণ, এমডির দায়দায়িত্ব, ক্ষমতাসহ নানা বিষয়ে বিস্তৃত শর্তারোপ করা হয়েছে। এর আগে চলতি ফেব্রুয়ারিতেই ব্যাংকের পরিচালক ও স্বতন্ত্র পরিচালকদের জন্য পৃথক নীতিমালা জারি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

আগেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকের এমডি পদে নিয়োগের শর্ত ও যোগ্যতা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিধিনিষেধ ছিল। তবে সেগুলো ছিল বিভিন্ন সময়ে জারীকৃত বিচ্ছিন্ন প্রজ্ঞাপন। এবারই প্রথম সব বিষয়ে বিস্তৃতভাবে তুলে ধরে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা জারি করা হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের জারীকৃত প্রজ্ঞাপনকে ইতিবাচক হিসেবে নিলেও অনেক বিষয়েই নিজেদের অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন। দেশের অর্ধডজন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেছেন, এমডি নিয়োগে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা থাকার বিষয়টি ইতিবাচক। কিন্তু নীতিমালায় এমন অনেক শর্ত দেয়া হয়েছে, যেগুলো আমলে নিলে ব্যাংকের জন্য এমডি খুঁজে পাওয়া যাবে না। যোগ্য ও দক্ষ ব্যাংক কর্মকর্তারা এমডি হতে চাইবে না। প্রজ্ঞাপনের অনেক শর্তে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সম্প্রতি তিনটি ব্যাংকের এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাক্ষাৎকার নিয়েছে। কিন্তু সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। এটি যেকোনো ব্যাংকের এমডির জন্য বিব্রতকর। বেতন-ভাতা, ছুটি, বিদেশ ভ্রমণসহ বিভিন্ন বিষয়ে এমন সব শর্তও জুড়ে দেয়া হয়েছে, যেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখতিয়ারভুক্ত নয়। প্রজ্ঞাপনটির মাধ্যমে মূলত এমডিদের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।’

তবে প্রজ্ঞাপন প্রস্তুতের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ‘‌দেশের ব্যাংকগুলোর এমডিরা অনেক বেশি বেতন পান, যা দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। মাসে ১৫-২০ লাখ টাকা বেতনের বাইরেও ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেন। এ কারণে কোনো এমডিই চাকরি ছাড়তে চান না। চাকরি বাঁচাতে তারা চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের যেকোনো অন্যায় আবদার নির্দ্বিধায় মেনে নেন। অনেক ব্যাংকের এমডিই লুটেরাদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করছেন। জারীকৃত প্রজ্ঞাপনটি বাস্তবায়ন করা গেলে এমডিদের চাকরিতে স্বচ্ছতা আসবে। একই সঙ্গে এমডিরাও চাকরির ক্ষেত্রে সুরক্ষা পাবেন।’

প্রজ্ঞাপনে ব্যাংক এমডিদের নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগের যোগ্যতা ও উপযুক্ততার বিষয়ে বলা হয়, ফৌজদারি আদালতে দণ্ডিত কিংবা জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্যান্য অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি ব্যাংকের এমডি হতে পারবেন না। এমডি সম্পর্কে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলায় আদালতের রায়ে কোনো বিরূপ পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য থাকবে না। কোনো নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের বিধিমালা, প্রবিধান বা নিয়মাচার লঙ্ঘনের কারণে দণ্ডিত না হওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। অবসায়ন বা লাইসেন্স বাতিল হয়েছে এমন কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত থাকার ইতিহাস থাকলেও কেউ এমডি হতে পারবেন না। কোনো কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বা লাইসেন্স বাতিলের সঙ্গে কারো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অপরাধ জড়িত থাকার ইতিহাস থাকলে তাকেও ব্যাংকের এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া যাবে না।

অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতি ও নৈতিক স্খলনের কারণে কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা পরিচালক বা কর্মকর্তা বা কর্মচারী থাকাকালীন স্বীয় পদ থেকে অপসারণ/বরখাস্ত/অবনমিত বা অব্যাহতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিও ব্যাংকের এমডি হতে পারবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট বা অনসাইট পরিদর্শনে তার বিরুদ্ধে কোনো বিরূপ পর্যবেক্ষণ থাকা যাবে না। ঋণখেলাপি, করখেলাপি, আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত ব্যক্তি এ পদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। পাওনাদারের প্রাপ্য পরিশোধ বন্ধ করে দেয়া বা আপসরফার মাধ্যমে পাওনা আদায় থেকে অব্যাহতি লাভ করা ব্যক্তিও ব্যাংকের এমডি হতে পারবেন না।

এমডি পদে নিয়োগ প্রাপ্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা, উপযুক্ততা ও অভিজ্ঞতার বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ন্যূনতম স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী হতে হবে। অর্থনীতি, হিসাববিজ্ঞান, ফাইন্যান্স, ব্যাংকিং, ব্যবস্থাপনা বা ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাগত শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। ডিজিটাল ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী নিয়োগের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

তবে শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়ে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণী থাকলে ওই ব্যক্তি কোনো ব্যাংকের এমডি হতে পারবেন না। প্রস্তাবিত পদের অব্যবহিত আগের পদগুলোয় সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর ওপর অর্পিত কাজ সম্পাদনের প্রমাণ ও সুনাম থাকতে হবে। প্রার্থীর নেতৃত্ব প্রদানের গুণাবলিও থাকতে হবে। তিনি ব্যাংক কোম্পানি আইন বা ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন, ২০২৩-এর অধীনে প্রতিষ্ঠিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বীমা কোম্পানি অথবা এ ধরনের কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে থাকতে পারবেন না বা এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো লাভজনক পদেও নিযুক্ত থাকতে পারবেন না। অন্য কোনো ব্যবসায়ে বা পেশায় নিয়োজিত থাকা যাবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে তার কোনো ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত থাকতে পারবে না। ব্যাংকের কোনো পরিচালকের মালিকানাধীন বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বা নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তার পরিবারের কোনো সদস্য থাকতে পারবে না। এমডি হতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যাংকিং পেশায় সক্রিয় কর্মকর্তা হিসেবে কমপক্ষে ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর ঠিক আগের পদে কমপক্ষে দুই বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এমডি হতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ন্যূনতম বয়স হবে ৪৫ বছর। কোনো ব্যক্তির বয়স ৬৫ বছর অতিক্রান্ত হলে তিনি কোনো ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে থাকতে পারবেন না। সাধারণভাবে এমডি পদের মেয়াদ হবে তিন বছর। তবে তিনি পুনর্নিয়োগের যোগ্য হবেন। পুনর্নিয়োগের সময় প্রার্থীর বয়স ৬৫ বছর পার হতে যদি তিন বছরের কম সময় থাকে, তাহলে ওই সময়ের জন্যও তাকে নিয়োগ দেয়া যাবে। তবে ব্যাংক থেকে যে মেয়াদের জন্যই প্রস্তাব করা হোক না কেন, প্রার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়ে তার উপযুক্ততা পরীক্ষার পর বাংলাদেশ ব্যাংক যে মেয়াদের জন্য সুপারিশ করবে, সে মেয়াদের জন্যই তাকে ব্যাংক এমডি হিসেবে নিয়োগ দেবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্তে আরো বলা হয়, এমডি পদে নিযুক্তি বা পুনর্নিযুক্তির জন্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ হ্রাস এবং অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা যুক্ত করতে হবে। সময়ে সময়ে এর অগ্রগতি পরিবীক্ষণ করতে হবে। একই সঙ্গে ওই পদে নিযুক্ত ব্যক্তির কর্ম মূল্যায়নের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট আর্থিক ও ব্যবস্থাপনাগত উন্নতি তথা অন্যান্য কর্মসম্পাদন সূচক বা নির্দেশক যুক্ত করতে হবে। আমানতকারী, ব্যাংক বা জনসাধারণের স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সময় সময় যেসব বিশেষ দায়িত্ব বা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হবে, নিয়োগের ক্ষেত্রে সেটিকেও কর্মসম্পাদন সূচক হিসেবে যুক্ত করতে হবে।

এমডিদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধার বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বেতন-ভাতাদি নিরূপণে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা, কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা, ব্যবসার পরিমাণ ও উপার্জন ক্ষমতার সাধারণ প্রবণতাগুলো আমলে নিতে হবে। আরো যেসব বিষয় আমলে নিতে হবে, সেগুলো হলো ব্যাংকের শাখা, উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের সংখ্যা, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যোগ্যতা ও অতীত কর্মসফলতা, বয়স ও অভিজ্ঞতা এবং ব্যাংকে নিযুক্ত অন্যান্য কর্মকর্তা বা সমপর্যায়ের অন্য ব্যাংক-কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতার পরিমাণ। মোট বেতন-ভাতা নিরূপণ হবে ‘‌মূল বেতন’ ও ‘‌বাড়ি ভাড়া’ বাবদ প্রত্যক্ষ বেতন ও ভাতা এবং অন্যান্য ভাতা (যদি থাকে) যোগ করে। প্রধান নির্বাহীর জন্য প্রস্তাবিত বেতন-ভাতা প্রজ্ঞাপনের সঙ্গে দেয়া ফরম্যাট অনুযায়ী দাখিল করতে হবে। অন্যান্য খাতে উল্লেখিত ভাতা, যেমন ইউটিলিটি বিল, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নিজের চিকিৎসা খরচ, ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়ামের সুনির্দিষ্ট পরিমাণ বা সীমা থাকবে। এছাড়া প্রদেয় অন্যান্য সুবিধা (যেমন গাড়ি, জ্বালানি, চালক ইত্যাদি), যতদূর সম্ভব অর্থমূল্যে নিরূপণ করে মোট মাসিক বেতন-ভাতা নির্ধারণ করতে হবে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এমডিদের উৎসব ভাতা হবে সর্বোচ্চ দুটি। প্রতিটি এক মাসের মূল বেতনের অধিক হবে না। লিভ-ফেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্স এক মাসের মূল বেতনের অধিক হবে না। প্রধান নির্বাহীর নিয়োগপত্রে উল্লেখিত চাকরির মেয়াদকালে বেতন-ভাতার কোনো শর্ত পরিবর্তন করা যাবে না মর্মে শর্ত আরোপ করতে হবে। তবে পুনর্নিযুক্তির ক্ষেত্রে কর্ম-উৎকর্ষ বিবেচনায় বেতন-ভাতা পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব করা যাবে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অন্য কোনো পরোক্ষ সুবিধা যেমন ব্যাংকের মুনাফার বিপরীতে কোনো লভ্যাংশ, কমিশন, ক্লাবের জন্য কোনো চাঁদা বা খরচ, বিদেশে চিকিৎসা খরচ বা বার্ষিক মেডিকেল চেকআপ বাবদ খরচ, বিদেশে পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা খরচ, ব্যক্তিগত ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিজের বা পরিবারের সদস্যদের বিদেশ ভ্রমণ ভাতা প্রাপ্য হবেন না। তবে তিনি নিজে বিদেশে (এশিয়ার যেকোনো দেশে) চিকিৎসা নিতে পারবেন। এক্ষেত্রে দেশের চিকিৎসা যথেষ্ট নয় মর্মে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রত্যয়ন জমা দিতে হবে। নিয়োগ চুক্তিভিত্তিক হওয়ায় চুক্তির মেয়াদকালে প্রধান নির্বাহীরা বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি সুবিধা, নববর্ষ ভাতা, ছুটি নগদায়ন, সুপারঅ্যানুয়েশন ফান্ড, বেনোভোলেন্ট ফান্ড ইত্যাদি সুবিধা প্রাপ্য হবেন না।

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বেতন-ভাতার বিপরীতে ব্যাংক কোনো আয়কর প্রদান করবে না বলেও প্রজ্ঞাপনে শর্তারোপ করা হয়। এতে বলা হয়, এমডিকে নিজ উৎস থেকে আয়কর প্রদান করতে হবে। নিয়োগের প্রস্তাবে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার প্রাপ্য বার্ষিক ছুটির পরিমাণ (ছুটির ধরনসহ) স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। অসংগতিপূর্ণ মাত্রাতিরিক্ত বেতন-ভাতার প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিবেচনাযোগ্য হবে না। ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের অনুকূলে উৎসাহ বোনাস প্রদান সাপেক্ষে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উৎসাহ বোনাস প্রাপ্য হবেন। তবে শর্ত থাকে যে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অনুকূলে প্রদেয় এরূপ উৎসাহ বোনাস বছরে ১৫ লাখ টাকার বেশি হবে না। ব্যাংকের অন্য কোনো কর্মকর্তা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার জন্য নির্ধারিত সীমার অধিক উৎসাহ বোনাসও প্রাপ্য হবেন না। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যাংকের বেতনভুক্ত কর্মকর্তা বিধায় পর্ষদ বা পর্ষদ কর্তৃক গঠিত কমিটির সভায় উপস্থিতির জন্য কোনো সম্মানী প্রাপ্য হবেন না।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এমডি পদে নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের লিখিত পূর্বানুমোদন গ্রহণ করতে হবে। নিয়োগের দুই মাস আগে প্রয়োজনীয় নথি ও তথ্যাবলিসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নিয়োগ প্রস্তাব দাখিল করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নরের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে মনোনীত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হবে। কমিটির ইতিবাচক সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক তার নিযুক্তি বা পুনর্নিযুক্তির অনুমোদন প্রদান করবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত তারিখ, সময় ও স্থানে তাকে সংশ্লিষ্ট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হতে হবে।

এমডি পদে পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেবেন। এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো খেলাপি ও অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের জন্য পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পরিমাণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দায়িত্ব অর্জনের অগ্রগতি প্রতিবেদন, সুনির্দিষ্টকৃত আর্থিক, ব্যবসায়িক ও ব্যবস্থাপনাগত উন্নতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিবরণ ও ব্যাংকের মুখ্য আর্থিক সূচকে উন্নতির বিবরণ।

এমডিদের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোনো ব্যাংকের এমডি দীর্ঘ সময়ের জন্য বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান যতদূর সম্ভব পরিহার করবেন। বিদেশ ভ্রমণ অত্যাবশ্যকীয় হলে গমনের ১০ কর্মদিবস আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নিতে আবেদন করতে হবে। এ অনুমোদন নিতে ব্যাংকের পাঠানো প্রস্তাবের সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের সত্যায়িত কপি, প্রস্তাবিত ভ্রমণের সময় (যাতায়াত সময়সহ), ভ্রমণের উদ্দেশ্য ও দেশের বাইরে অবস্থানকালীন ঠিকানা (একাধিক দেশ হলে প্রত্যেক দেশের নাম, সম্ভাব্য অবস্থানের মেয়াদ ও ঠিকানা), সংশ্লিষ্ট পঞ্জিকা বর্ষে বিদেশ ভ্রমণের সংখ্যা ও ভ্রমণের উদ্দেশ্য এবং সর্বশেষ ভ্রমণের তারিখ, দেশ, ব্যয়ের উৎসসহ অন্যান্য নথি জমা দিতে হবে।

এমডি পদ থেকে অব্যাহতি, বরখাস্ত বা অপসারণ সম্পর্কে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চরম স্খলন বা বিচ্যুতিপূর্ণ কাজ না করলে কোনো প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার চুক্তির মেয়াদপূর্তির আগে তাকে অপসারণ বা চুক্তি বাতিল করা যাবে না। চুক্তির মেয়াদপূর্তির আগে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার চুক্তি বাতিল বা তাকে অপসারণ করতে চাইলে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হবে। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের প্রস্তাবে অনুমোদন দিলে তা এক মাস পর কার্যকর হবে। আর প্রস্তাব নাকচ হলে সংশ্লিষ্ট প্রধান নির্বাহী চুক্তির মেয়াদের অবশিষ্ট সময় নিজ পদে বহাল থাকবেন। চুক্তির মেয়াদপূর্তির আগে প্রধান নির্বাহী ব্যক্তিগত বা অন্য কোনো কারণে পদত্যাগের আবেদন করলে তা পরিচালনা পর্ষদের সুপারিশসহ বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরণ করতে হবে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের কমিটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ব্যক্তিগত শুনানির ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটিই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৪৫ অথবা ৪৬ ধারার বিধান অনুসরণে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক যেকোনো ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে যেকোনো সময় তার পদ থেকে অব্যাহতি বা বরখাস্ত করতে পারবে। এমডি পদ শূন্য হলে সর্বোচ্চ তিন মাসের জন্য ভারপ্রাপ্ত এমডি নিয়োগ দেয়া যাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারীকৃত প্রজ্ঞাপনকে স্বাগত জানিয়েছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আগে এমডি পদে নিয়োগ ও এমডিদের দায়দায়িত্বের বিষয়ে এত বেশি বিস্তৃত কোনো নীতিমালা ছিল না। জারীকৃত প্রজ্ঞাপনে অনেক বিষয়ই স্পষ্ট করা হয়েছে। তবে প্রজ্ঞাপনে এমন অনেক শর্তও আরোপ করা হয়েছে, যেগুলো পালন করতে গিয়ে সমস্যা হতে পারে।’

Bonik Barta