স্বপ্না চক্রবর্তী
২৫ জুলাই ২০২৩
বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ
সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর এক দশক ধরে একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ। চারটি বিদেশী কোম্পানি কাজ শুরু করলেও তিনটি ছেড়ে গেছে বঙ্গোপসাগর। গত ১০ বছরে নতুন কোনো দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। নতুন করে দরপত্র আহ্বানের উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি) চূড়ান্ত হয়নি দুই বছরেও। তবে এবার বিদেশী কোম্পানিকে আগ্রহী করতে সুবিধা বাড়িয়ে পিএসসির খসড়া করা হয়েছে। যা চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। আজ বুধবার ক্রয় ও অর্থনীতি বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অনুমতি পেলে আবারও আহ্বান করা হবে দরপত্র। এতে করে আবারও সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি বছরের শেষের দিকেই কার্যক্রম শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে।
গ্যাস ও খনিজ প্রাপ্তির সম্ভাবনা বিবেচনায় দেশের স্থলভাগকে ২২টি এবং সমুদ্রভাগকে ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এই ২৬টির মধ্যে ১১টি ব্লক অগভীর সমুদ্রে অবস্থিত। বাকি ১৫টি গভীর সমুদ্রে। এখন পর্যন্ত শুধু অগভীর অংশের দুটি ব্লকে (এসএস-০৪ এবং এসএস-০৯) অনুসন্ধান চালাচ্ছে ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড ও অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড। চলতি বছরে তাদের জরিপ কাজের ফলাফল পাওয়ার কথা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি গভীর সমুদ্রের ১৫টি ব্লকের সবগুলোতে অনুসন্ধানের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে জ্বালানি খাতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোম্পানি এক্সন মোবিল।
এ তথ্য নিশ্চিত করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, এতদিন তো আমরা নির্দিষ্ট কোনো কোম্পানি পাচ্ছিলাম না যারা অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এবার এক্সন মোবিলের আগ্রহের কারণে আমরা আশাবাদী। পিএনসির যাচাই-বাছাই শেষ। চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়। আশা করছি কিছুদিনের মধ্যেই আমরা দরপত্র আহ্বান করতে পারব।
পেট্রোবাংলা বলছে, চলতি বছরের শুরু থেকেই পিএসসির যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু হয়। পরে জ্বালানি বিভাগের চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়ে এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হয়েছে। তার অনুমোদন পেলে চলতি বছরই সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র আহ্বান করতে চায় পেট্রোবাংলা। এর আগে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সবশেষ দরপত্র ডাকা হয়েছিল ২০১২ সালে। এরপর ২০১৯ সালে নতুন পিএসসি করা হলেও দরপত্র ডাকা হয়নি। দুই বছরের বেশি সময় ধরে নতুন পিএসসির কাজ চলছে। এখন এটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে জানিয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উড ম্যাকেঞ্জিকে দিয়ে পিএসসির একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। পেট্রোবাংলা নিজস্ব মতামতসহ এটি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠায় গত ফেব্রুয়ারিতে। আগেরটি থেকে এটিতে উৎপাদন ও দাম আরও আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে এতে কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর এটি অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রিপরিষদ কমিটি বিশ্লেষণ করবে। এই অনুমোদনের পর চূড়ান্ত পিএসসি ঘোষণা করা হবে।
দেশের জ্বালানি সংকটে যখন সারাদেশে ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন তখনই সুখবর দেয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের একটি পরিত্যক্ত কূপ থেকে নতুন করে গ্যাস সরবরাহ শুরু করে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি। এ কূপ থেকে দৈনিক ৮ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করার কথা জানায় বাপেক্স। শুধু এই কূপটিই নয় দেশের জ্বালানি সংকট মেটাতে আরও অন্তত: ২৯টি পরিত্যক্ত কূপে নতুন করে ওয়ার্কওভারের (সংস্কার) কাজ শুরু করে বাপেক্স। এর বাইরেও ২০২২-২০২৫ সময়কালের মধ্যে পেট্রোবাংলার মোট ৪৬টি অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার কূপ খননের পরিকল্পনায়ও এনেছে পরিবর্তন। ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ নাম দিয়ে এসব কূপে অনুসন্ধান, ওয়ার্কওভার, খনন ও উন্নয়ন কাজ শেষ করা হবে ২০২৪ সালের মধ্যেই। যদি এই প্রোগ্রাম সফলভাবে শেষ করা যায়, তাহলে দেশের জ্বালানির চাহিদা মেটাতে আমদানি নির্ভরতা অনেকটাই কমবে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
বাপেক্স সূত্রে জানা যায়, গত ৯ জুন বেলা ১১টার পর তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের ২৪ নম্বর কূপ থেকে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ শুরু হয়। পরিত্যক্ত হওয়ার পর কূপটির ওয়ার্কওভার (সংস্কার) করে বাপেক্স। ৪৫ দিনে ওয়ার্কওভার কাজ শেষ হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কূপটি খনন করেছিল চীনের কোম্পানি সিনো প্যাক। এরই ধারাবাহিকতায় আরও ২৯টি পরিত্যক্ত কূপ খনন, অনুসন্ধান ও ওয়ার্কওভারের সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. শোয়েব জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বজুড়ে একটা জ্বালানি সংকট চলছে। এর থেকে বের হতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
আমদানির জন্য নতুন বাজার খোঁজার পাশাপাশি দেশীয় কূপগুলো খননেও জোর দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা এসব পরিত্যক্ত কূপে নতুন করে অনুসন্ধান কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। এছাড়াও যে ৪৬টি কূপ ২০২২-২৫ সালের মধ্যে নতুন করে খনন, ওয়ার্কওভারের কথা ছিল সেগুলোর সময়ও কমিয়ে এনে একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে আগামী ২০২৪ সালের মধ্যেই কাজ শেষ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে দৈনিক অন্তত: ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রা আমরা নির্ধারণ করেছি।
স্থলভাগে কূপ খননের পাশাপাশি সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হলে দেশের জ্বালানি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে উল্লেখ প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে দেশে বাপেক্স দৈনিক ১৪৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করছে। এছাড়া বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) উৎপাদন করছে ৬১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। আর সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড উৎপাদন করছে ১০৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। সব মিলিয়ে এই তিন কোম্পানি দৈনিক মোট ৮৬৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করছে। আর বাকিটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শেভরন আর আমদানি করা এলএনজি।
কিন্তু এই উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে আগামী তিন বছর নতুন করে কূপ খনন করা হবে। এর সঙ্গে সব ঠিকঠাক থাকলে নতুন করে শুরু হবে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম। এক্সন মোবিল সম্মত হয়েছে। এখন পিএসসির চূড়ান্ত অনুমোদন হলে এর জন্য দরপত্র আহ্বান করার কার্যক্রম শুরু করা হবে। প্রধানমন্ত্রী কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলো ঠিকঠাক করে কাজ শুরু হবে।
চলতি বছরের ২৮ জুন জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে নসরুল হামিদ জানান, ২০০৬ সালে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ছিল দৈনিক ১ হাজার ৫০২ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমান চাহিদা প্রায় ৩ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। সে হিসেবে গত ১৬ বছরে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে ২ হাজার ১৯৮ মিলিয়ন ঘনফুট। একই সময়ে খনিজ তেলের চাহিদা বেড়েছে ৩০ লাখ মেট্রিক টন। প্রতিমন্ত্রী জানান, ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে দেশে খনিজ তেলের চাহিদা ছিল প্রায় ৩৫ লাখ ৭৩ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে চাহিদা প্রায় ৬৩ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদার বিপরীতে সরকারি ও বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১৪ লাখ মেট্রিক টন।
এছাড়া, অন্যান্য উৎস (সরকারি/বেসরকারি ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট) থেকে বার্ষিক ৪-৪.৫ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি পণ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে সংকটকালীন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে পেট্রোবাংলার সূত্র বলছে, এখন দেশে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কম এলএনজি আসছে। মূলত কাতার ও ওমানের দুটি কোম্পানি চুক্তির ভিত্তিতে এই এলএনজি সরবরাহ করছে। এর বাইরে স্পট মার্কেট থেকেও কিছু আমদানি করা হচ্ছে। ফলে বর্তমানে দেশে দৈনিক ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এরমধ্যে ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আসছে দেশী উৎস থেকে। দেশী তিনটি কোম্পানি ৮৪৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে। বাকিটা দিচ্ছে বহুজাতিক দুই কোম্পানি শেভরন এবং তাল্লো।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশে তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে তথ্যের ঘাটতির কথা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলেন বিশেষজ্ঞ ও সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা। সে তথ্যের জোগান দিতে ২০২০ সালে বঙ্গোপসাগরের গভীর ও অগভীর ব্লকগুলোতে মালটিক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভে (ভূকম্প জরিপ) শুরু করে নরওয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি টিজিএস-নোপেক এবং শ্লম্বার্জার। মে মাসে সে জরিপ কাজের তথ্য পেট্রোবাংলা হাতে পায়। আর আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন লাভজনক নয় বলে সরকারের সঙ্গে কাজ করেনি এত দিন। তাদের আগ্রহী করতে এবং দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব তৈরির লক্ষ্যে নতুন এই উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে জানিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।
যদি এটি শুরু হয় তাহলে দেশের অভ্যন্তরে তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই আলো দেখাবে উল্লেখ করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, ভারত-মিয়ানমার উভয় দেশের সঙ্গেই আমরা সমুদ্র বিজয় করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশগুলো সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অনেকটাই এগিয়ে গেলেও আমরা এখনো পিছিয়েই রয়েছি। এখনো পিএসসি চূড়ান্ত অনুমোদনই পায়নি। তবে যদি সত্যি সত্যি এ কার্যক্রম শুরু হয় তাহলে আশা করছি তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে আমরা অনেকটাই এগিয়ে যাব। শুধু স্থলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না আমাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম।