বিদ্যুতের পর জ্বালানি তেলের ব্যবসা যাচ্ছে বেসরকারিতে!

পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি, পরিশোধন, বিপণন ও মজুত সংশ্লিষ্ট নীতিমালায় বড় পরিবর্তন আনল সরকার। বিদ্যমান নীতিতে এসব ক্ষেত্রে একক নিয়ন্ত্রণ ছিল রাষ্ট্রের। এখন থেকে বেসরকারি খাতকেও জ্বালানি তেল আমদানি, পরিশোধন ও বিপণনের সুযোগ দেয়া হলো। এজন্য ‘বেসরকারি পর্যায়ে রিফাইনারি স্থাপন, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিপূর্বক মজুদ, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন ও বিপণন নীতিমালা-২০২৩’ শীর্ষক নীতিমালা জারি করেছে সরকার।

গতকাল নীতিমালাটি গেজেট আকারে জারি করা হয়েছে। তবে তা ১৫ নভেম্বর থেকে কার্যকর দেখানো হয়েছে। এ নীতিমালার মাধ্যমে জ্বালানি তেল ব্যবসায় নিজের একক নিয়ন্ত্রণের অবসান করল সরকার। বর্তমানে জ্বালানি তেল পরিশোধনের একক ক্ষমতা রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্টার্ন রিফাইনারির হাতে। আর তেল আমদানি ও বিপণনের ক্ষমতা রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে। তবে বেসরকারি খাতে রিফাইনারি স্থাপনের পর দুই সংস্থাই তেল আমদানি, পরিশোধন ও বিপণনের একক বাজার হারাবে।

নীতিমালার আওতায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে বিশেষ সুযোগও দিয়েছে সরকার। এতে উৎপাদিত জ্বালানি তেলের বিপণন শুরুর প্রথম তিন বছর ৬০ শতাংশ ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল কিনে নেবে বিপিসি। পরের দুই বছর পরিশোধিত জ্বালানি তেলের ৫০ শতাংশ কিনে নেবে রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটি।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, বেসরকারি রিফাইনারিতে উৎপাদিত ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল বিপণন শুরুর প্রথম ৩ বছর মোট উৎপাদিত জ্বালানি তেলের ৬০ শতাংশ সরকার-নির্ধারিত মূল্যে বিপিসিকে সরবরাহ করতে হবে। বাকি ৪০ শতাংশ জ্বালানি তেল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ও নিজস্ব নিবন্ধিত বিপণন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারবে। তবে বিক্রয় নেটওয়ার্কের স্বল্পতার কারণে কোনো বেসরকারি রিফাইনারি অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ তেল বিক্রি করতে না পারলে এর যেকোনো পরিমাণ বিপিসির কাছে বিক্রি করতে পারবে। তবে তা দুই মাস আগেই বিপিসিকে জানাতে হবে এবং বিপিসি তার চাহিদা অনুযায়ী তা কেনার জন্য চুক্তি করবে।

পরবর্তী ২ বছরে বেসরকারি রিফাইনারিগুলো তাদের উৎপাদিত তেলের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিক্রি করতে পারবে। অথবা বিপিসি ও বেসরকারি রিফাইনারি ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির মাধ্যমে এর পরিমাণ নির্ধারণ করবে। তবে বিপিসির চাহিদা না থাকলে সংস্থাটির অনাপত্তি গ্রহণ সাপেক্ষে বিদেশে পরিশোধিত জ্বালানি তেল রপ্তানিও করতে পারবেন বেসরকারি রিফাইনারি মালিকরা।

বেসরকারি উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত জ্বালানি তেল বিক্রি করতে দেশব্যাপী সড়ক, মহাসড়ক, উপজেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকাগুলোয় পেট্রোল পাম্প স্থাপন করতে পারবেন। এসব পেট্রোল পাম্পে সরকার নির্ধারিত খুচরা মূল্যে জ্বালানি তেল বিক্রি করা যাবে। আর বেসরকারি রিফাইনারিগুলো বছরে ন্যূনতম ১৫ লাখ মেট্রিক টন পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন রিফাইনারি স্থাপন করতে হবে।

বিপিসি সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ পাঁচটি বেসরকারি রিফাইনারি স্থাপন করলে দেশের পুরো চাহিদা মেটানো যাবে। এতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইস্টার্ন রিফাইনারির কোনো তেলই পরিশোধন করতে হবে না। অর্থাৎ বিদ্যুৎ খাতের মতো সরকারি রিফাইনারি বসে থাকবে আর বিপিসিকে বেসরকারি খাত থেকে তেল কিনতে হবে। আবার বেসরকারি রিফাইনারিগুলো নিজেরা পেট্রোল পাম্প স্থাপনের মাধ্যমে তেল বিক্রি শুরু করলে বিপিসির ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বাতিল করা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

যদিও এ নীতিমালার বিষয়ে শেয়ার বিজের কাছে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ইস্টার্ন রিফাইনারি ও বিপিসির কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

প্রসঙ্গত, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সরকারের পক্ষে জ্বালানি তেলের সরবরাহ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিপিসি। আর অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে ১৯৬৮ সালে স্থাপিত দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল পরিশোধন কোম্পানি ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করছে বিপিসি। এ রিফাইনারির বার্ষিক পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন, যা দিয়ে দেশের মোট চাহিদার ২০ শতাংশ মেটানো যায়। দেশের জ্বালানি তেলের চাহিদার বাকি ৮০ শতাংশ পরিশোধিত তেল আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়।

সক্ষমতা বাড়াতে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারি ইউনিট-২ স্থাপনের প্রকল্প নিয়েছে বিপিসি, যা ২০২৭ সালে নির্মাণ সম্পন্ন হবে। এটি হলে আরও ৩০ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করা সম্ভব হবে। তবে বেসরকারি খাতে রিফাইনারি স্থাপনের পর ঝুঁকিতে পড়বে বিপিসির এ বিনিয়োগ।

জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন আইন- ২০১৬ এবং ন্যাশনাল এনার্জি পলিসি ১৯৯৬-এর মতো বিভিন্ন আইন ও বিধিমালায় প্রদত্ত ক্ষমতা ও নির্দেশনা মোতাবেক বেসরকারি পর্যায়ে রিফাইনারি স্থাপনের নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যোগ্যতার শর্ত: নীতিমালায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আবশ্যিক যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, উদ্যোক্তাদের জ্বালানি পণ্য খাতের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এজন্য বিদেশি যেকোনো কোম্পানির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের গত ৫ বছরের মধ্যে যেকোনো ৩ বছরে প্রতি বছর টার্নওভার কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকা বা সমমূল্যের মার্কিন ডলার হতে হবে।

বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বা তার কোনো পরিচালক ঋণখেলাপি হতে পারবে না। নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, বেসরকারি খাতে রিফাইনারি স্থাপনের জন্য কমপক্ষে ৮০ একর জমি থাকতে হবে এবং রিফাইনারির অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ন্যূনতম ২ লাখ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন স্টোরেজ সুবিধা থাকতে হবে।

রিফাইনারি স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর, বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর আগে নিরাপত্তা গ্যারান্টি হিসেবে বিপিসির অনুকূলে বেসরকারি উদ্যোক্তাকে ২৫০ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হবে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির পর নিজস্ব মালিকানায় বা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় লাইটারেজ জাহাজ, কোস্টাল ট্যাঙ্কার ও ট্যাংকলরি থাকতে হবে।

সূত্র : শেয়ার বিজ