বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারছে না বেজা

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রতিষ্ঠা হয় ২০১১ সালের নভেম্বরে। এরপর সময় পেরিয়েছে এক যুগেরও বেশি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেজার তত্ত্বাবধানে উৎপাদন শুরু করতে পেরেছে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশী বিনিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে দেড় বিলিয়ন (১৫০ কোটি) ডলারের। যদিও ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে মোট ৫৮ লাখ ১০ হাজার ডলারের নিট প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ধীরগতি ও বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশের ঘাটতির কারণে এসব অঞ্চল বিনিয়োগকারীদের এখন আর সেভাবে আকর্ষণ করতে পারছে না। তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বেজার অনুমোদন তথ্য ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানের ব্যবধানে।

এ বিষয়ে বেজার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাবি, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য হালনাগাদ নয়। বেজার ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেজার বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সংস্থাটিতে প্রকৃত বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, সর্বশেষ হালনাগাদ অনুযায়ী বেজার অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে বেজার অধীন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিদেশী বিনিয়োগ প্রবাহের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে মূলত ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে। ওই অর্থবছরে অর্থনৈতিক অঞ্চলে নিট এফডিআই প্রবাহ এসেছে সাড়ে ৩ লাখ ডলার। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে নিট এফডিআই প্রবাহ আসে ৪১ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে এসেছে ১৩ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় নিট এফডিআই প্রবাহ এসেছে ৫৮ লাখ ১০ হাজার ডলার।

অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিদেশী বিনিয়োগ না আসার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে ইউটিলিটি সেবা নিশ্চিত করতে না পারাকে দায়ী করছেন বিনিয়োগকারীরা। তবে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো আশাবাদী তারা। তারা মনে করেন, মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কারণে কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হওয়ায় এসইজেডগুলো বাস্তবায়নের গতি কিছুটা ধীর হয়েছে। তবে নানা জটিলতা সত্ত্বেও মিরসরাইয়ের মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলোর কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। আড়াই হাজার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (এসইজেড) কাজও ভালোই এগিয়ে চলেছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধির প্রত্যাশা, এসইজেডগুলোর মধ্যে গড়ে তোলা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করবে, যা অন্যান্য স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরও বাংলাদেশে আকর্ষণ করে নিয়ে আসবে।

দেশে বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই)। জানতে চাইলে সংগঠনটির সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি রূপালী চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বেজা বলছে অনেকগুলো কোম্পানি আসছে, অনেক এমওইউ স্বাক্ষর হচ্ছে, বিনিয়োগ অন্বেষণ হচ্ছে। আমরা যদি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর দিকে নজর দেই, দেখা যাচ্ছে অনেকগুলো বিদেশী কোম্পানি বিনিয়োগে এসেছে। আমরা যদি সরকারিগুলোর দিকে তাকাই সেখানেও কিছু বিদেশী কোম্পানি এসেছে। কিন্তু আমরা যদি অনুমোদিত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর ব্যাপ্তি বিবেচনা করি, তাহলে খুব বেশি কোম্পানি কি এখন পর্যন্ত এসেছে?’

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতা উল্লেখ করে রূপালী চৌধুরী বলেন, ‘‌আমরা অনেকগুলো রোড শো করেছি। এতে করে কিছু কোম্পানিও আগ্রহ দেখিয়েছিল। বাস্তবতা হলো যে পরিমাণ বা গতিতে আমরা বিনিয়োগ প্রবাহ প্রত্যাশা করছি, সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা সময়ের ব্যাপার। সড়ক অবকাঠামোসহ আরো বেশকিছু অগ্রগতি হয়েছে। আমার মনে হয় গতিটা আরো ভালো হবে। বিনিয়োগকারীদের যে সুবিধাগুলো দেয়া হচ্ছে, অন্যান্য দেশের সঙ্গে সেগুলোর বেঞ্চমার্কিং করা প্রয়োজন। যার মাধ্যমে আর্থিক নীতিতে আরো সুবিধা দেয়া যায় কিনা, সেটা দেখা প্রয়োজন।’

কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিদেশী বিনিয়োগ না পেলেও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ দেশী ও বিদেশী ঋণ করতে হয়েছে বেজাকে, যা এরই মধ্যে ৮২ কোটি ৬৮ লাখ ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যে উঠে এসেছে।

এ ঋণ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, অবকাঠামো প্রকল্পে ঋণগুলো এক ধরনের বিনিয়োগ, যার ফল পাওয়া যাবে দীর্ঘমেয়াদে। যে ঋণ চুক্তিগুলো হয়েছে, সেগুলোর আওতায় প্রকল্প চলমান রয়েছে। বোঝা সৃষ্টি হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। এখন পর্যন্ত মোট চারটি ঋণ চুক্তি হলেও একটির পরিশোধ শুরু হয়েছে। বাকিগুলোর পরিশোধের সময় এখনো আসেনি।

ইআরডির ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বেজার ঋণগুলো মূলত জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে পাওয়া। এর মধ্যে ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন প্রকল্পের অধীনে জাপানি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নে জাইকার সঙ্গে বেজার এক ঋণ চুক্তি সই হয় ২০১৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর। এ চুক্তির আওতায় ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার ৮২৫ মিলিয়ন ইয়েন। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা বিনিময় হারের তৎকালীন তালিকা অনুযায়ী ডলারে এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ কোটি ১৫ লাখ ৩৯ হাজারে।

দ্বিতীয় ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন প্রকল্প বাস্তবায়নে জাইকার সঙ্গে বেজার ঋণ চুক্তি হয় ২০১৯ সালের ২৯ মে। ঋণের পরিমাণ ২১ হাজার ১৪৭ মিলিয়ন ইয়েন। তৎকালীন বিনিময় হার অনুযায়ী ডলারে এর পরিমাণ ১৯ কোটি ৫৩ লাখ ২৮ হাজার ২০৭।

২০২১ সালের ২৩ এপ্রিল বেজার সঙ্গে ঋণ চুক্তি হয় বিশ্বব্যাংকের। বেজাসহ এ চুক্তির আওতায় রয়েছে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক অথরিটিও। বাংলাদেশ প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ডিজিটাল অন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ (পিআরআইডিই) শীর্ষক ওই প্রকল্পের আওতায় ঋণের পরিমাণ ৫০ কোটি ডলার।

এছাড়া মিরসরাইয়ে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে দেশটির এলওসির আওতায় বেজার অনুকূলে বড় আকারের একটি ঋণ ছাড় হওয়ার আলোচনা চলছে।

পরিকল্পিত শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের প্রবাহ, কর্মসংস্থান ও শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির তাগিদ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। বেজার বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত এর মধ্যে ৯৭টির অনুমোদন হয়েছে। নির্মাণাধীন রয়েছে ২৯টি। উৎপাদনে যেতে পেরেছে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল। এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা পাওয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় উৎপাদনরত কারখানা আছে ৪১টি। নির্মাণাধীন কারখানা ৫০টি। অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রস্তাবিত মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ২৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে অনুমোদিত প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ দেড় বিলিয়ন ডলার।

‌বিনিয়োগ পরিবেশ পরিবর্তনের কার্যকর প্রয়াস থাকলে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিদেশী বিনিয়োগের চিত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাবে বলে আশাবাদী এফআইসিসিআইয়ের বর্তমান সভাপতি জাভেদ আখতার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌‌বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক বড়। এ সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ দিতে বহুমাত্রিক সহায়তা দরকার। বেজায় দরকার কার্যকর সহযোগিতা ও সমন্বয়। বেসরকারি খাতকে সঙ্গে নিয়ে তারা যদি কাজগুলো করতে পারে, তাহলে বিনিয়োগের গতিটা বাড়ানো সম্ভব হবে। অর্থনৈতিক যে চ্যালেঞ্জ বর্তমানে রয়েছে তা সাময়িক, এ থেকে হয়তো বাংলাদেশ উত্তরণ করবে কিন্তু বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সামষ্টিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভূমিকা প্রয়োজন। সবাই মিলে বিনিয়োগ প্রমোশন পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন। আমরা মনে করি বিনিয়োগ পরিবেশ পরিবর্তনের একটা সামষ্টিক প্রচেষ্টা নিলে অনেক ভালো করা সম্ভব। বাংলাদেশ সম্ভাবনার জায়গা, যা বাস্তবে রূপ দিতে মূলত সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বেজার নির্বাহী সদস্য অতিরিক্ত সচিব মো. মজিবর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বেজা দেশী-বিদেশী দুই ধরনের বিনিয়োগেই সমানভাবে উৎসাহ দেয়। এখন পর্যন্ত দেশী বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরও বিনিয়োগ আগ্রহ আমরা দেখতে পাচ্ছি। অনেক দেশ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগ আগ্রহ দেখাচ্ছে এবং করছেও। এখন পর্যন্ত দেড় বিলিয়ন ডলারের বিদেশী বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া হয়েছে, এ ধারা ইতিবাচক। যে গতিতে এফডিআই আসার কথা ছিল, সেই গতিও ঠিক আছে বলেই আমি মনে করি। বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশী বিনিয়োগের তথ্যে বেজার তথ্য হালনাগাদ করেনি। তাই বেজা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে তারতম্য রয়েছে। এ বিষয়ে আমরা এক দফা চিঠিও দিয়েছি।’

বেজার ঋণ ও এ-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মজিবর রহমান বলেন, ‘‌অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঋণ নেয়া হয়ে থাকে। ঋণ পরিশোধের কোনো বোঝা বেজার নেই, কারণ যে লক্ষ্যে ঋণ নেয়া হয়েছে, সেই লক্ষ্য অনুযায়ী প্রকল্পের কার্যক্রম চলছে। অবকাঠামো তৈরির পর যে সেবা দেয়া হবে সেই সেবার আয় দিয়েই ঋণ পরিশোধ সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি।’

Bonik Barta