বিদেশীরা কাতার থেকে যা শিখে গেল?

  • রফিকুল হায়দার ফরহাদ, কাতার থেকে
  •  ২১ ডিসেম্বর ২০২২, ১৫:৪৮
বিদেশীরা কাতার থেকে যা শিখে গেল? – ছবি : সংগৃহীত

‘কাতার বিশ্বকাপের আয়োজনটা খুবই চমৎকার। ইচ্ছে করলে দিনে একাধিক ম্যাচও দেখা যায় স্টেডিয়ামে বসে।’ ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলার লুকা মদরিচ।

‘কাতার বিশ্বকাপের ভেন্যু গুলো খুব কাছে হওয়ায় এক স্টেডিয়ামে খেলা শেষ করে অন্য ম্যাচ খেলতে আরেক স্টেডিয়ামে যেতে মোটেই সময় তেমন লাগে না। সর্বোচ্চ এক ঘণ্টার পথ। এতে আমাদের বিশ্রাম নেয়ার পর্যাপ্ত সময় জুটছে। যা অন্য বিশ্বকাপে কল্পনাই করা যেত না। বিমানে ২-৩ ঘণ্টা তো লাগতোই। সাথে হোটেল ছেড়ে আরেক হোটেলে উঠার প্রক্রিয়াগত ঝামেলা।’ আর্জেন্টিনার ফুটবলার রদরিগো ডি পল।

কাতার ২০২২ বিশ্বকাপ চলার সময় ম্যাচ পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে এভাবেই এবারের আসরের প্রশংসা করেছিলেন এই দুই খেলোয়াড়। একজনের দল বিশ্বকাপ জিতেছে। অন্যজন দলকে তৃতীয় স্থান পেতে সাহায্য করেছে। স্টেডিয়ামের দূরত্ব তাদের মন জয় করেছে। সে সাথে এই মুসলিম দেশের আয়োজনটা মুগ্ধ করেছে বিদেশী সাংবাদিক, দর্শক এবং মিডিয়া কর্মীদের।

অবশ্য পশ্চিমা মিডিয়া নানা খুঁত বের করে সমালোচনার তীর ছুঁড়ছেই। কিন্তু অনন্য নজীর স্থাপন করেছে কাতার বিশ্বকাপ। প্রায় দু’হাজার বিদেশী কাতারে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। এই তথ্য কাতার নিউজ এজেন্সির। ২০১৪ বিশ্বকাপে লিওনেল মেসির বন্ধু আর্জেন্টিনার সাংবাদিক সন্ত্রাসী হামলায় মারা গিয়েছিল ব্রাজিলের মাটিতে। খেলা শেষে মদ্যপ সমর্থকদের মধ্যে মারামারি করতেও দেখা গেছে। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলা শেষে মাতাল অবস্থায় বাসে উঠে দর্শক এবং সাধারণ মানুষকে বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্ম দিতেন। কিন্তু কাতারের এবার এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। স্টেডিয়ামে বিয়ার পান করাও নিষিদ্ধ ছিল।

গভীর রাতে খেলা শেষে মহিলা দর্শকরা নিরাপদেই ঘুরাঘুরি করেছেন। কোনো ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আর্জেন্টিনার মহিলা এক দর্শক বললেন, না কোনো সমস্যাই তো নেই রাতে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে। যথেস্ট নিরাপদ কাতার।

ইসলাম এবং মুসলিম বিরোধী ব্যাপক প্রচারণা ছিল এই কাতার বিশ্বকাপ ঘিরে। কিন্তু ফিফার সহায়তায় কাতার সরকার প্রমাণ করেছে একটি মুসলিম দেশ কতোটা নিরাপদ। তারাও পারে অসাধারণ আয়োজনে বিশ্বকাপ শেষ করতে। আইনের সঠিক প্রয়োগ থাকলে কিভাবে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত নিরাপদ থাকে।

প্রায় রাতের খেলা শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে ফযরের আজান দিয়ে দিতো। তখনও দেখা যেত একা একা মহিলারা কাজ শেষ করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছে। নেই কোনো ভয়-ডর। কারণ প্রশাসন এখানে এতোটাই কড়া যে পার পাওয়ার কোনো সুযোগই নেই। রাস্তায় রাস্তায় সিসিটিভি লাগানো। কোনো ঘটনা সিসিটিভিতে ধরা না পড়লে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সনাক্ত করার ব্যবস্থা আছে।

সাথে চলতো ইসলামের প্রচারণাও। লুসাইর স্টেডিয়ামের সামনে খেলার আগে ফ্রি-তে খেজুর, কেক, বিস্কুট এবং কফি বিতরণ করে গ্রাহকদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হতো একটি কার্ড। যে কার্ডের বারকোড স্ক্যান করলেই কোরআন ও হাদীসের বাণী। ব্যক্তিগত উদ্যোগেই এই প্রচারণা চালানো বলে জানান মিসরের দুই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি।

কাতার বিশ্বকাপই একমাত্র আসর যেখানে হিজাবের সাথে নিকাব পরা মেয়েদের স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। এদের একজন মিসরের আসমা আবদুল হামিদ, অপরজন কাতারেরই নোরা আল খাবি। নোরা কাতারের সাংবাদিক এবং দেশটির প্রখ্যাত ইউটিউবার। তিনি জানান, আমাকে বিদেশীরা প্রশ্ন করতো, হয়তো আমি দেখতে ভালো না তাই নিকাব পরি। অথবা আমাকে জোর করেই এটা পরতে বাধ্য করা হয়েছে। এরপর আমার উত্তরগুলো ছিল সুন্দরভাবে ইসলামের দাওয়াত আকারে। এর মাধ্যমে আমরা কিন্তু একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছি বিদেশীদের কাছে।

এই বিদেশীদের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল কাতার কর্তৃপক্ষ। সেখানে তুলে ধরা হয় ইসলাম এবং আরব সংস্কৃতি। এতে বিমোহিত অতিথিরা। আর্জেন্টিনার সাংবাদিক ম্যাথিয়াস, জার্মানির ৮৫ বছরের মিডিয়া কর্মী হুবোর্টের মতে, কাতার বিশ্বকাপ এক কথায় অতুলনীয়।

মেক্সিকান পঙ্গু মহিলা দর্শক ম্যাগলেনিয়ার মতে, আমি এ পর্যন্ত যতো বিশ্বকাপ ফুটবল দেখেছি, কাতারই সেরা। তা আয়োজনের দিক থেকে।

উল্লেখ্য, যেসব দর্শক হোটেলে থাকতো তাদের বিনা পয়সায় হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল কাতার সরকার। সাথে মেট্রো আর বাসে যাতায়াততো ফ্রিই ছিল। অবশ্য রাশিয়াও গত আসরে বাস, ট্রেন ও মেট্রো ফ্রি করেছিল।

আর যাই হোক যারা ইসলাম, মুসলমান এবং আরবদের বিষয়ে বিরূপ ধারণা পোষণ করতেন এতো দিন তারা ভালো একটা বার্তা নিয়ে দেশে ফিরে গেছে এবং যাচ্ছে। যা ইসলামের নীরব প্রচারণাই হয়েছে।