বিতর্কিত ভোটের ‘সহযোগী’ কর্মকর্তাদের কপাল পুড়ছে

বিতর্কিত ভোটের ‘সহযোগী’ কর্মকর্তাদের কপাল পুড়ছে

সংসদের শেষ তিন নির্বাচন নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। এবার সেসব নির্বাচনে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কপাল পুড়তে যাচ্ছে। বারবার প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসাতে ভূমিকা রাখা কর্মকর্তাদের তালিকা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে বিভাগীয় কমিশনার ও রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসকের (ডিসি) তালিকা প্রস্তুত হয়ে গেছে। এখন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে থাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কয়েক মাসের মাথায় বিতর্কিত তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সহায়তা দেওয়া কর্মকর্তাদের খোঁজে নামল সরকার।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এসব কর্মকর্তা বারবার বিতর্কিত নির্বাচন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার সহযোগী। তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরানো হচ্ছে। ভবিষ্যতেও জুটবে না বড় পদ। বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজনে জড়িতদের বিচারের দাবিও উঠেছে। বিচার হলে তালিকাভুক্ত কর্মকর্তাদের শাস্তিও পেতে হবে।

বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসির ২৩ পৃষ্ঠার দুটি আলাদা তালিকা হাতে পেয়েছে সমকাল। তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এতে তিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা ২৪ বিভাগীয় কমিশনারের নাম রয়েছে। যারা ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন, তারা এরই মধ্যে অবসরে গেছেন। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় দায়িত্বে থাকা চার বিভাগীয় কমিশনার এখনও পদে আছেন। তারা হলেন চট্টগ্রামের তোফায়েল ইসলাম, খুলনার মো. হেলাল মাহমুদ শরীফ, রাজশাহীর ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর ও সিলেটের আবু আহমেদ ছিদ্দিকী। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়োগ পাওয়া তিন বিভাগীয় কমিশনারকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সরিয়েছে। একজনকে আওয়ামী লীগ সরকারই অন্যত্র বদলি করে।

রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ২০৮ জেলা প্রশাসকের নাম রয়েছে তালিকায়। ৬৪ জেলায় তিন নির্বাচনে ১৯২ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন। তবে তপশিল ঘোষণার পর তিন নির্বাচনে ১৬ জেলা প্রশাসকের বদলির কারণে রিটার্নিং কর্মকর্তার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০৮।

২০১৪ সালের নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ৬৭ জেলা প্রশাসকের ৪৩ জন অবসরে গেছেন। ওই নির্বাচনের বাকি রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পরের দুই নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তারা এখনও চাকরিতে আছেন। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দায়িত্বে থাকা সবাইকে সরানো হয়েছে। আগের দুই নির্বাচনের কয়েকজন রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে দু’জনকে।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার আড়াই বছর পর সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে আওয়ামী লীগ। দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের বিরোধিতা করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১২৫, জাতীয় পার্টি (জাপা) ২২, জাসদ ২, ওয়ার্কার্স পার্টি ২, জেপি ১ এবং তরীকত ফেডারেশন একটি আসনে বিনা ভোটে জয়ী হয়। বাকি ১৪৭ আসনে ভোট গ্রহণ করা হয়। দিনভর কেন্দ্র ফাঁকা থাকলেও ভোটের হার দেখানো হয় ৪০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।

অভিযোগ আছে, এসব আসনের নির্বাচনে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে ভোটের হার বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সে সময়কার রিটার্নিং, সহকারী রিটার্নিং ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা এতে জড়িত বলে বারবার অভিযোগ উঠেছে। যদিও কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন নির্বাচন কমিশন এবং আওয়ামী লীগ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

‘রাতের ভোট’ খ্যাত ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। সেই নির্বাচনে আগের রাতেই ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্স ভরা হয়। অস্বাভাবিক ফলাফলের ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং বিএনপি ১৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে বলে দেখানো হয়। বিএনপি পেয়েছিল ছয়টি আসন। আওয়ামী লীগ ২৫৮ ও জাতীয় পার্টি ২২ আসন পায়।

একাদশ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার দেখানো হয় ৮০ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। যদিও রাতের বেলায় বাক্স ভরার অভিযোগে নির্বাচনের দিন সকালে শতাধিক আসনে ভোট বর্জন করেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা। যদিও চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা যায়, ১০৩ আসনের ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ১ হাজার ২০৫ কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়ে ৬ হাজার ৪৮৪ কেন্দ্রে। আর ৮০ থেকে ৮৯ শতাংশ ভোট পড়ে ১৫ হাজার ৭১৯ কেন্দ্রে, যা ছিল অস্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের শতাধিক প্রার্থী ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন বলে দেখানো হয়।

তখন থেকেই প্রচলিত কথা ছিল– রিটার্নিং, সহকারী রিটার্নিং ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নির্বাচনের আগে ব্যালটে সিল দিয়ে ভোটবাক্স বোঝাই করে পুলিশ। যদিও কে এম নুরুল হুদার নির্বাচন কমিশন এবং আওয়ামী লীগ সেই অভিযোগ নাকচ করে।

বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ফেনীতে ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনটি আসনেই জয়ী দেখানো হয় আওয়ামী লীগ জোটের প্রার্থীদের। আওয়ামী লীগ জোটের প্রার্থীরা অস্বাভাবিক ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পান। যতবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে, ততবারই ফেনী-১ আসনে জয়ী হয় বিএনপি। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার এ আসনে একাদশ নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ২৪ হাজার ৯৭২ ভোট পায়। নৌকা প্রতীকে জাসদের শিরিন আখতার ২ লাখ ৪ হাজার ২৫৬ ভোট পেয়েছেন বলে দেখানো হয়। এমন অস্বাভাবিক ফলাফল ছিল নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ সারাদেশেই।

ফেনীতে একাদশ নির্বাচনের সময় ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন সেবাস্টিয়ান রেমা। তিনি এখন মানবাধিকার কমিশনে কর্মরত। ২৩ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচন পর্যন্ত রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন আবদুল মতিন। এই যুগ্ম সচিব বর্তমানে পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে পরিচালক (অর্থ) পদে রয়েছেন।

অস্বাভাবিক ফলাফল ছিল কুমিল্লার ১১ আসনেই। কুমিল্লা-১১ আসনে আওয়ামী লীগের মুজিবুল হকের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীও হতে পারেননি ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করা জামায়াতে ইসলামীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের। সাবেক এই এমপি নৌকার ২ লাখ ৮২ হাজার ৩ ভোটের বিপরীতে পেয়েছিলেন ৭৮৩ ভোট।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লার রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন প্রশাসনের ২০ ব্যাচের কর্মকর্তা আবুল ফজল মীর। তিনি ২০২১ সালের ১ নভেম্বর যুগ্ম সচিব হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে যোগ দেন। গত ১ সেপ্টেম্বর তাঁকে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে বরিশালে বদলি করা হয়েছে।

২০১৮ সালের নির্বাচনে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক ছিলেন ১৮ ব্যাচের কর্মকর্তা তন্ময় দাস। পরের পাঁচ বছরে দুটি পদোন্নতি পেয়ে তিনি অতিরিক্ত সচিব হন। গত এপ্রিলে যোগ দিয়েছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে। গত ৭ সেপ্টেম্বর তাঁকে ওএসডি করা হয়। ২ অক্টোবর তিনি এ পদে যোগ দিয়েছেন।

২০১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন মো. ইসমাইল হোসেন। তিনি ২০২২ সালের জুনে সচিব পদে পদোন্নতি পান। যোগ দেন খাদ্য সচিব হিসেবে। ১০ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার তাঁকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে বদলি করে। এর ১২ দিনের মাথায় তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।

২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়ে দিনাজপুরের রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন আবু হেনা মোরশেদ জামান। পরে তিনি স্থানীয় সরকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের সচিব ছিলেন। ৬ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার ওএসডি করেছে ১১ ব্যাচের এই কর্মকর্তাকে। ২০১৪ সালে ফেনীর রিটার্নিং কর্মকর্তার পদে থাকা দশম ব্যাচের কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর খোন্দকার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ছিলেন শেখ হাসিনার সরকারে। গত ১২ সেপ্টেম্বর তাঁকে ওএসডি করা হয়েছে।

দশম ব্যাচের কর্মকর্তা মাসুদ করিম ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় খাগড়াছড়ির রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন। পরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। অভ্যুত্থানের পর তাঁকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরে বদলি করা হয়। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ সচিব মো. কামরুল হাসান বহাল রয়েছেন। ১১ ব্যাচের এই কর্মকর্তা ২০১৪ সালে মৌলভীবাজারের রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন।

ডামি নির্বাচন খ্যাত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও বর্জন করে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। আওয়ামী লীগ নেতারাই নৌকার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন এই নির্বাচনে। ৭ জানুয়ারির ভোটের ৬৪ রিটার্নিং কর্মকর্তাকেই সরিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

কেন এ তালিকা করা হয়েছে– এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেসুর রহমানের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। অতিরিক্ত সচিব বাবুল মিঞা সচিবের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, তালিকার বিষয়টি জানা নেই।

উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই জনপ্রশাসনের দায়িত্বে রয়েছেন। জনপ্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, বিতর্কিত নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের তালিকা প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হবে।

কী কারণে তালিকা করা হয়েছে, তা জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমকাল। তিনি বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জেনে এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে হবে।

samakal