ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরদিন গত ৯ আগস্ট বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় নেমে আসতে শুরু করেন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। এসব স্থানের মধ্যে ছিল রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ শাহবাগ মোড়ও। হিন্দুরা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে তড়িঘড়ি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। সে সময় ৫ থেকে ৮ আগস্ট হিন্দুদের বেশ কিছু বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে হামলার অভিযোগ এনে রাস্তায় নেমে আসেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এসব মানুষ।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের মতো সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর ডাকে সাড়া দিয়ে এসব বিক্ষোভে অংশ নেন হাজারো মানুষ।
বিক্ষোভকারীদের স্লোগানে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়া ও তাঁদের ব্যাপারে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়। তবে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের কারও কারও মুখে ছিল, ‘জয় শ্রী রাম’ (রামের জয়) স্লোগান। ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিতর্কিত একটি স্লোগান এটি।
বিক্ষোভের তৃতীয় দিন (৯ আগস্ট শুরু), ১১ আগস্ট বাংলাদেশ হিন্দু জাগরণ মঞ্চ (বিএইচজেএম) নামে একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠন করা হয়। নিহার হালদার, জুয়েল আইচ অর্ক, জয় রাজবংশী, রনি রাজবংশী ও প্রদীপ কান্তি দে সংগঠনটির সমন্বয়ক ও প্রধান মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। এদিনই গঠিত হয় বিএইচজেএমের ফেসবুক গ্রুপও।
ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সহযোগী সংগঠন হিন্দু জাগরণ মঞ্চের (এইচজেএম) সঙ্গে বাংলাদেশ হিন্দু জাগরণ মঞ্চের (বিএইচজেএম) নামের অদ্ভুতভাবে মিল রয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আদর্শিক সাংগঠনিক গুরু হলো আরএসএস। এইচজেএমের অনেক নেতাই বিজেপির হয়ে কাজ করেন।
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ভারতে প্রথম বিক্ষোভ করে এইচজেএম। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় এ বিক্ষোভ হয়; এমনকি ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূস শপথ নেওয়ার আগেই।
পরবর্তী সপ্তাহগুলোয় বাংলাদেশের প্রচলিত সংখ্যালঘু সংগঠনগুলো পর্দার আড়ালে চলে যায়। সেই সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে উত্থান ঘটে নতুন প্ল্যাটফর্ম বিএইচজেএমের।
বিক্ষোভকারীদের স্লোগানে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়া ও তাঁদের ব্যাপারে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়। তবে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের কারও কারও মুখে ছিল, ‘জয় শ্রী রাম’ (রামের জয়) স্লোগান। ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিতর্কিত একটি স্লোগান এটি।
এ প্ল্যাটফর্মের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকেরা সবাই বাংলাদেশ হিন্দু ছাত্র মহাজোট ও হিন্দু যুব মহাজোটের সঙ্গে যুক্ত। এই দুই সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের (বিজেএইচএম) যথাক্রমে ছাত্র ও যুব শাখা। ২০০৬ সালে ঢাকায় গঠিত হয় হিন্দু অধিকার সংগঠন বিজেএইচএম। বাংলাদেশের অনেকে মনে করেন, এই সংগঠনের ভেতরেই এ দেশের হিন্দুত্ববাদের শিকড় নিহিত।
বিজেপি ও এইচজেএমসহ আরএসএসের সহযোগী দল বা সংগঠনগুলোকে একসঙ্গে সংঘ পরিবার বা আরএসএস পরিবার হিসেবে ডাকা হয়। হিন্দুত্ববাদ হলো এদের স্বঘোষিত আদর্শ। এ আদর্শকে এরা ‘হিন্দু সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ বলে আখ্যা দেয়।
এসব সংগঠন যদিও এদের আদর্শকে জাতীয়তাবাদ হিসেবে তুলে ধরে থাকে, প্রকৃতপক্ষে তা ভারতীয়দের ভৌগোলিক সীমানায় আটকে নেই। সংঘ পরিবার তার অখণ্ড ভারত বা অবিভক্ত ভারত প্রতিষ্ঠার যে ধারণা, সেটিই প্রচার করে থাকে। এ ধারণায় এরা আফগানিস্তান থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার, নেপাল ও তিব্বত থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত একটি একক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে।
বিতর্কিত ভারত ভ্রমণ
পূজা পার্বণ নামে ৩৪ হাজার ফলোয়ারের একটি ফেসবুক পেজ থেকে ১২ আগস্ট নিহার হালদার ও ইসকনের সাবেক গুরু চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে বাংলাদেশে হিন্দুদের নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এর পরের কয়েক সপ্তাহে হালদার ও চিন্ময় হিন্দুদের বিক্ষোভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক হিসেবে আবির্ভূত হন।
হালদার বিএইচজেএমে অন্যতম নেতৃস্থানীয় ভূমিকা অব্যাহত রাখেন। গত ৮, ১৩, ২০, ২৭ সেপ্টেম্বরসহ বিভিন্ন তারিখে বাংলাদেশের নানা অংশে কয়েক দফা বিক্ষোভের আয়োজন করে সংগঠনটি। ২৭ সেপ্টেম্বর এই সংগঠন সপ্তাহব্যাপী বিক্ষোভের ঘোষণা দেয়। ইতিমধ্যে চিন্ময় চট্টগ্রামে হিন্দুদের বিক্ষোভে গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়ে ওঠেন। সেখানে সম্মিলিত সনাতনী ছাত্র সমাজের ব্যানারে বিক্ষোভ আয়োজন করা হচ্ছিল।
যাহোক, বিক্ষোভে হাসিনার আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নেতাদের দৃশ্যত প্রভাব রাখার সুযোগ দেওয়া নিয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর বিএইচজেএমে ভাঙন ধরে। এ ক্ষেত্রে হালদারের ভারত সফর মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। মধ্য সেপ্টেম্বরে ভারতে যান তিনি। ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে নিজের বৈঠকের ছবি তিনি তাঁর ফেসবুক পেজগুলোর একটি থেকে শেয়ার করেন। পরে পেজটি স্থগিত করা হয়।
এসব ছবিতে বাংলাদেশে ফেরার আগে হালদারকে ২১ সেপ্টেম্বর বিজেপির ত্রিপুরা বিধানসভা সদস্য প্রতিমা ভৌমিক, ২৭ সেপ্টেম্বর ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সাবেক গভর্নর তথাগত রায়, ১ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সাংস্কৃতিক শাখার আহ্বায়ক রুদ্রনীল ঘোষ, ২৮ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিদলীয় সংসদ সদস্য অসীম সরকার, ৭ নভেম্বর বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ শাখার সাবেক সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং সবশেষ ৯ নভেম্বর আবার প্রতিমা ভৌমিকের সঙ্গে দেখা যায়।
১ অক্টোবর ঢাকায় বিএইচজেএম একটি বিবৃতি দেয়। সেখানে বলা হয়, দেশে না ফেরা পর্যন্ত হালদারকে সব দায়দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। বিদেশে অবস্থানকালে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন, সেসবের দায় এ সংগঠন নেবে না।
শিগগিরই বিএইচজেএমের অপর অংশও একটি বিবৃতি দেয়। সেখানে তারা উল্লেখ করে, বিএইচজেএমের নামকরণ হয়েছে বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ (বিএসজেএম)। তারা হালদারকে সংগঠনের সমন্বয়ক ও চিন্ময়কে মুখপাত্র হিসেবে ঘোষণা করে।
অক্টোবরজুড়ে বিএইচজেএম ও বিএসজেএম বিক্ষোভের আয়োজন করে যায়। যদিও আলাদাভাবে তারা কর্মসূচি চালিয়ে গেছে, তবে পরেরটি (বিএসজেএম) বেশি পরিচিতি অর্জন তথা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। ভারত থেকে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশে ফিরে চিন্ময়ের সঙ্গে প্রথম জনসমক্ষে দেখা দেন হালদার। এরই মধ্যে তিনি (চিন্ময় দাস) রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে পরিণত হন।
১৭ নভেম্বর বিএসজেএম ঘোষণা করে, তারা বাংলাদেশ সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে। প্রচলিত হিন্দু সংগঠনগুলোর এ জোট গত সেপ্টেম্বরে গঠিত হয়। চিন্ময় দাসকে মুখপাত্র করে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট নামে নতুন এক প্ল্যাটফর্ম চালু করতে গঠন করা হয় এটি।
ইতিমধ্যে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানের ধারক বিক্ষোভকারীদের প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাসহ বাংলাদেশের অনেকে। ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আক্রমণ উসকে দিতে এ স্লোগানের ভূমিকা তুলে ধরেন তাঁরা।
‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান যে শুধু বিজেপি-আরএসএসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তা নয়; এ স্লোগানই উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ১৯৯২ সালে উত্তর ভারতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় ব্যবহার করেছিলেন। এ ছাড়া লোকজন, বিশেষ করে মুসলিমদের হয়রানি করা ও তাঁদের ওপর আক্রমণ চালানোর ক্ষেত্রে স্লোগানটি ব্যবহার করার বহু উদাহরণ আছে।
ভারতে বিজেপির সমালোচকেরা যুক্তি দেন, ‘জয় সিয়া রাম’, ‘হে রাম’, ‘রাম রাম’, ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’—এসব স্লোগান রামের স্তুতি প্রকাশে প্রথাগতভাবে ব্যবহার করে থাকেন ধার্মিক হিন্দুরা। তবে ‘জয় শ্রীরাম’—এটি একটি রাজনৈতিক স্লোগান।
আরএসএস এবং এর সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলো যদিও এদের হিন্দুত্ববাদী আদর্শকে জাতীয়তাবাদ হিসেবে তুলে ধরে থাকে, প্রকৃতপক্ষে তা ভারতীয়দের ভৌগোলিক সীমানায় আটকে নেই। এই সংঘ পরিবার এদের অখণ্ড ভারত বা অবিভক্ত ভারত পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে ধারণা, সেটিই প্রচার করে থাকে। এ ধারণায় এরা আফগানিস্তান থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার, নেপাল ও তিব্বত থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত একটি একক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে।
বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত, এ দেশে হিন্দুত্ববাদী আদর্শের শিকড় ২০০৬ সালে বিজেএইচএম বা হিন্দু মহাজোট গঠনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাদের নেতারাই জয় শ্রীরামের মতো স্লোগানের ব্যবহার শুরু করেছিলেন। পরের বছর তাঁরা সংগঠিত হতে শুরু করেন, যদিও তা ছিল ছোট পরিসরে—রামনবমী আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এ উৎসবকে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা পেশিশক্তি প্রদর্শনে ব্যবহার করেন।
হিন্দু মহাজোট বিদেশে শাখা খুলেছে। আরএসএসের আরেক সহযোগী বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) সঙ্গে সাংগঠনিক যোগাযোগ বজায় রাখছে তারা।
২০১৬ সালে বিজেএইচএম ভেঙে যায়। পরে জোড়া লাগার চেষ্টা করে তারা। কিন্তু ২০২০ সালের শুরুতে আবারও ভাঙে। প্রবাস চন্দ্র রায় ও পলাশ কান্তি দের নেতৃত্বাধীন একাংশ মহাসচিব গোবিন্দ প্রামাণিককে আবার বহিষ্কার করে। প্রামাণিকও ওই অংশের নেতাদের বহিষ্কার করেন। ভাঙনের কারণ ছিল প্রামাণিকের রাজনৈতিক অবস্থান। তিনি আওয়ামী লীগকে ‘নিঃশর্ত সমর্থন’ দেওয়ার হিন্দুদের কৌশলের বিরোধী ছিলেন।
এ ভাঙনের পর প্রবাস-পলাশ ও গোবিন্দ—দুই অংশই হিন্দুত্ববাদকে নিজেদের আদর্শ বলে দাবি অব্যাহত রাখে। যদিও গোবিন্দ প্রামাণিক হাসিনার (আওয়ামী লীগের সভাপতি) বিরোধীদের, বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা চালান। প্রবাশ-পলাশ অংশ বলেছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে যেকোনো রকমের যোগাযোগ অগ্রহণযোগ্য।
২০২১ সালে গোবিন্দ প্রামাণিক হিন্দুদের ইস্যুতে ভারতের ভূমিকার সমালোচক হিসেবেও আবির্ভূত হন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার (আওয়ামী লীগ সরকারের সময়) করার বিষয়টি আরএসএস, বিজেপি ও ভিএইচপির বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার সামনে তুলে ধরা হলেও মোদির সরকার হাসিনা সরকারকে খোশমেজাজে রাখতে এ ব্যাপারে নমনীয়তা দেখাচ্ছে। বিজেএইচএমের অপর অংশ আওয়ামীপন্থীই রয়ে গেছে। ফলস্বরূপ ভারতপন্থী হয়ে আছে তারা।
শেখ হাসিনার পতনের পর বিজেএইচএমের প্রবাস-পলাশ অংশের ছাত্র ও যুবকর্মীরা বিভিন্ন হিন্দু সংগঠনের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখে। এরই ধারাবাহিকতায় গঠিত হয়েছে হিন্দু জাগরণ মঞ্চ ও পরবর্তী সময়ে সনাতন জাগরণ মঞ্চ।
বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজেএইচএমের এক নেতা দ্য ডিপ্লোম্যাটকে বলেছেন, বাংলাদেশে ভারতের হিন্দুত্ববাদের প্রতীক, যেমন ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান, ক্রুদ্ধ হনুমানের ছবি, রামনবমীর মতো অনুষ্ঠান এবং লাভ জিহাদের মতো বিভিন্ন ইস্যুতে প্রচার-প্রচারণার ব্যবহার জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে ২০২২ সালে।
এই হিন্দু নেতা আরও বলেছেন, ‘২০২১ সালের শেষ দিকে হিন্দুদের ওপর হামলা অনেককে উগ্র হিন্দুত্ববাদ গ্রহণে পরিচালিত করেছে, যেমনটা ভারতে চর্চা করে থাকে আরএসএস। “মৌলবাদী” ইসলামপন্থীদের মোকাবিলায় হিন্দুদের প্রতিরোধ হিসেবে তাঁরা জয় শ্রীরাম স্লোগানকে ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেন। লোকজন, বিশেষ করে হিন্দু তরুণেরা আরএসএস-সংশ্লিষ্ট ভারতীয় ব্যবহারকারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হওয়া শুরু করেন।’
২০২২ সালে বিজেএইচএমের দুই অংশ রামনবমী উৎসব উদ্যাপন করে বড় পরিসরে। সে বছরের আগস্টে হিন্দুদের জন্মাষ্টমীর উৎসবে তাদের স্লোগান ছিল, ‘যিনি কৃষ্ণ তিনি রাম/ জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীরাম’ (অর্থাৎ কৃষ্ণ ও রাম একই/ রামের জয়)। তাঁরা এ স্লোগানও তোলেন, ‘জয় হিন্দুত্ববাদ’ (হিন্দুত্ববাদের জয় হোক)।
ভগবান কৃষ্ণই শুধু হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন—এমন ধারণার প্রকাশ ঘটিয়ে ওই নেতারা বারবার এ যুক্তি তুলে ধরেন, যেহেতু কৃষ্ণ ও রাম একই, তাই সবার জয়ধ্বনি দেওয়া উচিত, ‘জয় শ্রীরাম’ (ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের স্লোগান)।
২০২৩ সালে জাতীয় হিন্দু ছাত্র মহাজোট বাংলাদেশে নিজেদের প্রথম হিন্দুত্ববাদী (হিন্দুত্ববাদের অনুসারী) ছাত্রসংগঠন হিসেবে পরিচয় দেয়। হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদ রক্ষা করাই তাদের লক্ষ্য বলে জানায় এই মহাজোট। একটি অনুষ্ঠানে জোটের নেতারা বলেন, হিন্দুত্ববাদ তাঁদের আদর্শ ও ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান—শুধু এ কারণে বিজেপির সঙ্গে তাঁদের যুক্ত করাটা ঠিক হবে না। তাদের যুক্তি, তারা আন্তর্জাতিক সংগঠনের বাংলাদেশি শাখা।
বিএইচজেএমের একজন নেতার যুক্তি, ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি অনেককে তাঁদের কট্টরপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছে। জোটের এ সংগঠক বলেন, ‘নিহার হালদারের পরিবার “মুসলিমদের” কাছে নিজেদের সম্পত্তি খুইয়েছে। তাঁরা তাঁদের সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। প্রশাসন তাদের সহায়তা করেনি। একজন উগ্রবাদী হিন্দুকর্মীতে পরিণত হওয়ার জন্য আমি তাঁকে দোষ দিতে পারি না। তাঁর হতাশা তাঁকে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের সহায়তা চাইতে বাধ্য করেছে।’
মন্তব্য জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও হালদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
বিএইচজেএমের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন রনি রাজবংশী। ২০২৩ সালে তিনি মহাখালী স্বয়ংসেবক ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) গড়ে তোলেন। ‘স্বয়ংসেবক’ শব্দটি আরএসএসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আরএসএস তাদের সদস্যদের এ নামে ডেকে থাকে। সংস্কৃত ভাষার এ শব্দকে স্বেচ্ছাসেবক বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত লোকজনই শুধু ভারতে স্বেচ্ছাসেবক অর্থে এ শব্দের ব্যবহার করেন। এখন বাংলাদেশে এমএসএফও তাদের স্বেচ্ছাসেবকদের স্বয়ংসেবক বলে ডাকছে।
এ সংগঠনের নাম-পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সদস্য দাবি করেন, ‘হিন্দুত্ববাদ হলো একটি হিন্দুধর্মীয় আদর্শ। এটির কোনো সীমানা নেই। আরএসএস বা বিজেপির সঙ্গে আমাদের কোনো সাংগঠনিক যোগাযোগ নেই।’ তাঁর আরও দাবি, ‘ধর্মনিরপেক্ষ-উদার সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা’ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশকে আলাদাভাবে দেখেন। জামায়াতকে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও দ্বিতীয়টিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেন তাঁরা।
‘কিন্তু তাঁরাই (ওই সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা) আবার আরএসএসের সঙ্গে আমাদের যুক্ত করেন,’ আক্ষেপ করে বলেন এ সদস্য।
অনুবাদ: মো. আবু হুরাইরাহ্
prothom alo