বিক্ষোভে উত্তাল বুয়েট

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের গভীর রাতে প্রবেশের ঘটনায় দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেছেন হাজারো শিক্ষার্থী। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে গতকাল সকালে ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা লাগাতার পাঁচ ঘণ্টার অধিক সময় বিক্ষোভ করেন তারা। সেই সঙ্গে আজও আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তারা।

গতকাল সকাল ৮টা থেকে বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনে জড়ো হতে থাকেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শহীদ মিনারে বাড়তে থাকে উপস্থিতি। এ সময় তারা নানা স্লোগানে উত্তাল করে রাখেন ক্যাম্পাস। নির্ধারিত টার্ম ফাইনাল ও ক্লাস বাদ দিয়ে হাজির হওয়া শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক নেতাদের অনুপ্রবেশে সহায়তাকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাতে থাকেন।

বেলা ১১টায় আন্দোলনের অবস্থা ও ঘটনাপ্রবাহ অনুযায়ী পরিবর্তিত দাবি উপস্থাপন করে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এতে শিক্ষার্থীরা পূর্বের ঘটনায় প্রশাসনের গৃহীত পদক্ষেপ যথেষ্ট নয় বলে জানান। নতুন করে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাদের সমাগমের ঘটনায় পুরকৌশল বিভাগের ২১তম ব্যাচের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের হলের সিট বাতিল করা হয়েছে। তবে ইমতিয়াজ এবং ঘটনায় জড়িত অন্য পাঁচ শিক্ষার্থীকে স্থায়ী বহিষ্কারসহ ছয় দফা দাবি সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন শিক্ষার্থীরা।
সংবাদ সম্মেলনে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালা লঙ্ঘন করে পুরকৌশল বিভাগের ২১তম ব্যাচের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম এ সমাগম ঘটান।এ ঘটনায় শুক্রবার বিকালে বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনে শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করেন।

তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালকের (ডিএসডব্লিউ) কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্ষোভ দেখান। এরপর রাতে বুয়েটের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ফোরকান উদ্দিনের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের হলের সিট বাতিল করা হয়।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের সঙ্গে বুয়েটের বাকি যেসব শিক্ষার্থীরা জড়িত তাদের একাংশের নাম-পরিচয় ও ছবি ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা হলেন- বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এ এস এম আনাস ফেরদৌস, ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মোহাম্মদ হাসিন আরমান নিহাল, অনিরুদ্ধ মজুমদার, সায়েম মাহমুদ সাজেদিন রিফাত এবং নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের জাহিরুল ইসলাম ইমন।

ইমতিয়াজের মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবিধানের নিয়ম ভঙ্গের দায়ে এবং বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক অপশক্তি অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টা করায় তাদের সকলকে স্থায়ীভাবে একাডেমিক ও হল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে, বহিরাগত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে প্রশাসনিকভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ছাত্রকল্যাণ দপ্তর পরিচালকের পদত্যাগ, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ার প্রশাসনিক প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আমাদের আন্দোলনের পর তথাকথিত রাজনৈতিক সংগঠনের কিছু ব্যক্তিবর্গকে ফেসবুকে পোস্ট করে আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে অপপ্রচার চালাতে দেখি। আমরা তাদের এমন বক্তব্যের ধিক্কার জানাই। আমরা সবসময়ই বুয়েটের সংবিধানে থাকা ‘বুয়েটে সকল রকম ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ’-এই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সংঘবদ্ধ এবং যেকোনো মূল্যে বুয়েটকে ছাত্ররাজনীতির হাত থেকে মুক্ত রাখতে বদ্ধপরিকর।

পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আন্দোলন স্থগিত করে শিক্ষার্থীরা। চলমান কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সকাল ৭টায় শহীদ মিনারের সামনে জড়ো হবেন শিক্ষার্থীরা। আজও টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
এদিকে এই ঘটনায় আরেকটি সংবাদ সম্মেলন করেন বুয়েটের পাঁচ শিক্ষার্থী। তারা বলেন, শিক্ষার্থীদের আবেগকে ব্যবহার করে একটি অন্ধকার সংগঠনের ইন্ধনে বুয়েটে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বুয়েটে কার্যক্রম চালাচ্ছে ইসলামী ছাত্রশিবির ও নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীর। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির হয়ে যিনিই কথা বলছেন, তাকেই ‘ছাত্রলীগ’ ট্যাগ দিয়ে বারবার অত্যাচার করা হচ্ছে।

তারা নিজেদের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ২০২৩ সালের জুলাইয়ে সুনামগঞ্জের হাওরে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও নাশকতার অভিযোগে বুয়েটের প্রাক্তন এবং বর্তমান ৩৪ জন শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার হন। তাদের নামে এখনো আদালতে মামলা চলমান এবং সবাই জামিনে আছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী মৌলবাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করি। এই মানববন্ধন করার পর আমাদের চিহ্নিত করে ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং জবাবদিহি চাওয়া হয়। বিভিন্ন হলের কক্ষে কক্ষে রাত ১১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ডেকে জবাবদিহি চাওয়া হয়। এমনকি মানববন্ধনকে একটি অপরাধের সঙ্গে তুলনা করে আমাদের হল থেকে বের করে দেয়ারও হুমকি দেয়া হয়।
বুধবার মধ্যরাতে বুয়েটে ছাত্রলীগের প্রবেশের বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, আমরা শুনেছি, সেখানে একটি ছাত্র সংগঠনের সভাপতি এসেছিলেন। তিনি আসতেই পারেন। তিনি তো কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাননি।

এদিকে গতকাল দুপুরে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন নিয়ে বুয়েটের ভাইস চ্যান্সেলর সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একমত বুয়েট প্রশাসন। কিন্তু আইনের বাইরে কিছু করা সম্ভব নয়। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৮ তারিখের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এর পর একাডেমিক কাউন্সিল বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবে। শনিবার যেসব পরীক্ষা ছিল, সেখানে তাদের অনুপস্থিত দেখানো হবে। নিয়ম মতো রিটেক হয়ে যাবে। পরীক্ষার জন্য আবেদন করলে, একাডেমিক কাউন্সিল বিবেচনা করতে পারে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে, বুয়েট আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভিসি শুধু হল  থেকে বহিষ্কার করতে পারেন। শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যবস্থা নেবে, একাডেমিক কাউন্সিল।  তিনি বলেন, ছাত্র কল্যাণ পরিচালকের অনুমতি নেয়নি, বহিরাগতরা। কাজেই,  তার পদত্যাগের দাবি অবান্তর।

ওদিকে গতকাল রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, বুয়েটে কোনো জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর গোপনে কার্যক্রম পরিচালনা করলে তা গভীরভাবে তদন্ত করা হবে। কিছুদিন আগেও অনেকে অভিযোগ করেছেন কিছু জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী গোপনে সেখানে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এমন একটি আলোচনা-সমালোচনা ছিল। সে বিষয়টি আমরা আরও গভীরভাবে তদন্ত করবো। তবে চলমান আন্দোলন নিয়ে শিক্ষার্থীসহ উভয় পক্ষকে আহ্বান জানাবো, সেখানে শিক্ষার পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

manabzamin