বিএনপি তো কোন বিপ্লবী দল না, তার ওপর ভরসা করি কেন?

 

ফরহাদ মজহার    6 December 2023

বিএনপি ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্টদের পাতানো নির্বাচনে যাচ্ছে না। এতে বিএনপির প্রতি সমর্থন ও সহমর্মিতা সাধারন মানুষের মধ্যে বাড়ছে। পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে সেটাই এখন প্রশ্ন।
এটা ঠিক যে আমরা কঠিন সময়ের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছি। নির্বাচনপন্থি দল হয়েও মনোনয়নপত্র জমা না দেওয়া বিএনপির জন্য বড়সড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এটাই বিএনপির জন্য শাপে বর হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুর্দশা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষয় ঘটেছে, বা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সীমাহীন দুর্নীতি, শক্তিশালী মাফিয়া ও লুটেরা শ্রেণীর আবির্ভাব এবং নির্বাচনে কালো টাকার ছড়াছড়ি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মাফিয়া ও ফ্যাসিস্ট না হলে প্রথাগত নির্বাচনবাদী কোন দলের পক্ষেই ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব না। চরম ফ্যাসিস্ট ও দমন পীড়নে সিদ্ধ না হলে ক্ষমতা ধরে রাখাও যাবে না। এই অবস্থায় বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়া বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য খুবই ইতিবাচক হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দরকষাকষির ক্ষেত্র এখন আগের চেয়ে বিএনপির জন্য অনেক সহজ।
বাংলাদেশের জনগণ স্রেফ রাজরাজড়ার বদল চায় না। এটা দেশে বিদেশে সকলেই কমবেশী বুঝে গিয়েছে। ইসরাইল-হামাস যুদ্ধেও পরাশক্তিগুলোর বিস্তর শিক্ষণীয় নিষয় আছে। আমরা সংখ্যায় কমপক্ষে সতেরো কোটি। গা ঝাড়া দিয়ে উঠলে রাজনৈতিক ভূমিকম্প হবে। বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করাই তাই এখনকার কাজ। বিএনপি এই কর্তব্য কতোটুকু বোঝে জানি না, কিন্তু এই বোঝাবুঝির ওপর দলটির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
নিয়মতান্ত্রিক ও লিবারেল রাজনীতির পরিবেশ বাংলাদেশে নাই বললেই চলে। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বিচারের অক্ষমতা আছে আমাদের।পাশাপাশি রাজনৈতিক আকাল মোকাবিলা করবার দক্ষতাও আমামদের নাই। তাই আমাদের প্রত্যেককেই আন্তরিক ভাবে ভাবতে হবে, আমরা আসলে কি চাই এবং কিভাবে চাই। আদর্শিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং গণক্ষমতার ভিত্তির ওপর বাংলাদেশকে শক্তিশালী দাঁড় করাতে হলে আমাদের সুনির্দিষ্ট চিন্তা ও পদক্ষেপ কি হবে, ইত্যাদি। বৃহত্তর গণঐক্য গড়ে তোলার জন্য আমাদের তাত্ত্বিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতা, কৌশলগত পদক্ষেপ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মারাত্মক ভুল ইত্যাদি  দ্রুত শোধরানো দরকার। জনগণকে অবশ্যই নতুন রাজনীতির দিশা দিতে হবে। এটাই বিএনপির চ্যালেঞ্জ।
 অনেকে আমাকে যথার্থই প্রশ্ন করেন যে বিএনপি তো কোন বিপ্লবী দল না, তার ওপর ভরসা করি কেন? এটা কারো ওপর ভরসা করা বা না করার ব্যাপার না। না, আমি কারো উপরই ভরসা করি না। একই প্রশ্ন ষাট দশকের শেষের দিকে আওয়ামী লীগ সম্পর্কেও আমরা হরদমই শুনতাম। শেখ মুজিবর সিয়াটো-সেন্টো চুক্তি করেছিলেন। তিনি বিপ্লবী না, বৃটিশ পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে বিশ্বাসী। ফলে তাঁর দ্বারা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ আদায় হবে না।
কিন্তু ইতিহাস ভিন্ন রায় দিয়েছে। ‘বিপ্লব’ নিয়া আমাদের — বিশেষত শহুরে পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর মহা রোমান্টিক গালগল্প ও ধ্যানধারণা আছে। তারা আজ এই দিক তো কাল অন্য দিক। যারা একদা ঘোর বিএনপি বিরোধী বলে জানতাম তাদের দেখলাম হঠাৎ সব বিএনপি হৈয়া গেছে। কয় কি? তাদের ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। তাই এখনই আমগোরের ভোটের অধিকার নিয়া কথা বলতে হবে। বিএনপিরে বুঝাইয়া দেওয়া দরকার আমরা তাগো ভোটের অধিকারের আন্দোলনে আছি। কিন্তু ফরহাদ মজহার খারাপ, কারন তিনি গণঅভ্যুথানের কথা বলেন। আসলেই। আমি খারাপ। শ্রমিকের ন্যুনতম মজুরির লড়াইয়ে তাগোরে আর পাওয়া গেল না।
রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা বিকাশের মূল কথা হোল আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণকে বাংলাদেশের সংকটের চরিত্র বোঝানো। মাঠের লড়াই জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করে। এটাই পথ। শর্টকাট নাই। জনগণকে আমরা কতোটা বোঝাতে পারলাম সেটাই আসল কথা। বুঝলে তাদের কর্তব্য তারা নিজেরাও নির্ণয় করতে পারবে। আন্দোলন জনগণই সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আমাদের এখনকার কাজ হচ্ছে মাফিয়া ও লুটেরা শ্রেণির নির্বাচন সর্বস্ব রাজনৈতিক ধারার বাইরে গণ রাজনৈতিক ধারাকে যতোটা সম্ভব বিকশিত করে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করা। একে পথ হারিয়ে যেতে না দেয়া।
পনের বছর আগে বলেছিলাম ‘যুদ্ধ আরও কঠিন, আরও গভীর’। এখন মনে হচ্ছে  হতাশ হওয়ার কিছু নাই।