পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য, কিছু কথা

  • আবুল কালাম মানিক
  •  ২৪ আগস্ট ২০২২, ১৯:৪৮
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য, কিছু কথা – ফাইল ছবি

গত ১৮ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরের জেএন হলে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্মাষ্টমী উৎসবের অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, তিনি ভারতে গিয়ে বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করার দরকার তাই করার অনুরোধ করেছেন। মন্ত্রীর এই বক্তব্য দেশব্যাপী তোলপাড় ও কূটনীতিক মহলে বিস্ময় সৃষ্টি করলেও, তা একবারেই আঁতকে ওঠার মতো নয়। এমনকি তা অভিনব কিংবা নজিরবিহীনও নয়। কারণ, এটি মোটেও অজানা বিষয় নয় যে, শুধু একটি গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচনের আশায় বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলো অতীতে বহুবার শক্তিশালী রাষ্ট্র কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থা- বিশেষ করে জাতিসঙ্ঘের কাছে ধরনা দিয়েছে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য। তবে সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষকদের অভিযোগ, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বচন কেবল দুই দেশের কূটনীতিকদের জন্য বিব্রতকর নয়, তা দেশের জন্য মর্যাদাহানিকর। সরকারি দলের দায়িত্বশীল কিছু নেতা মন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, আবদুল মোমেন আওয়ামী লীগের কেউ নন। তাকে এমন বক্তব্য রাখার অনুমতি দেয়া হয়নি। অথচ তিনি দলের একজন এমপি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জনজীবনে তোলপাড় সৃষ্টিকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। যদিও দলগুলো এ ধরনের অযাচিত বক্তব্য আগে কখনো শোনেনি এমন নয়, বরং বহুবার শুনেছে।

বাংলাদেশের বিবদমান বিভাজিত রাজনীতিতে এটি নতুন কোনো অভিজ্ঞতাও নয়। কখনো কখনো বাস্তবতা কূটনীতির সীমারেখা পর্যুদস্ত করে দেয়। কূটনীতিক সেই মুহূর্তে সত্য চেপে রাখতে অসমর্থ হয়ে পড়েন। জনাব আবদুল মোমেন বর্তমানে এমন এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। কারণ, তিনি হয়তো সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছেন। এ ধরনের বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ঢাকায় ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের এক অযাচিত ঝটিকা সফরে। বেশির ভাগ বিরোধী দলের বর্জনের মুখে যখন বাংলাদেশের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন একবারেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল তখন কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ঢাকায় পৌঁছান সুজাতা সিং। তিনি ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ৪-৫ তারিখ ঢাকায় অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাথে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন।

বৈঠক শেষে জাতীয় পার্টিপ্রধান সাংবাদিকদের সামনে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সফররত ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব তার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একতরফা সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে তিনি সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব একই পদমর্যাদার ব্যক্তি নন। সুজাতা সিং ভারত সরকারের একজন কর্মচারী ছাড়া আর কিছুই নন। তার সফরের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সাবেক এক রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, দেশের বিবদমান দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেননি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। ঢাকাকে নয়াদিল্লির একটি স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেয়াই ছিল সফরের মূল লক্ষ্য। সে সময়ে বিরোধী দলগুলো চাপ সৃষ্টির ওই ঘটনার প্রতিবাদ করলেও, সরকারি দল আওয়ামী লীগ ছিল সম্পূর্ণ চুপ। এ কে আবদুল মোমেন বর্তমান সরকারের একজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। কোনো কোনো আওয়ামী লীগ নেতা ভারত সরকারের কাছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথিত অনুরোধের ব্যাপারে ক্ষোভ ও উষ্মা প্রকাশ করেছেন। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত গুরুতর হস্তক্ষেপের ঘটনায় একজন ভিনদেশী সরকারি কর্মচারীকে ছাড় দিয়ে আওয়ামী লীগ যে উদারতার নজির স্থাপন করেছে, তা অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু এ কে আবদুল মোমেন সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও প্রায় একই ধরনের ঘটনায় নিজ দলের কাছ থেকে কোনো ধরনের অনুকম্পা লাভে সমর্থ হননি। তার জন্য বিষয়টি অবশ্যই দুর্ভাগ্যের।

এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিদেশে আমাদের বন্ধু আছে, কোনো প্রভু নেই। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, অন্যের আনুকূল্যে টিকে থাকলে সরকারে থাকার অধিকার নেই। একধাপ এগিয়ে, জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের বলেছেন, সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধ করার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের বক্তব্য দেশের সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের দায় সরকার এড়াতে পারে না।

বিদেশীদের হস্তক্ষেপে কিংবা আনুক‚ল্যে সরকার গঠন অথবা টিকে থাকার প্রয়াস বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা। রাজনৈতিক নেতারা এ বাস্তবতা অনেক আগেই মেনে নিয়েছেন। গত চার দশকে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজির বাংলাদেশে নেই। ক্ষমতার বাইরের দলগুলো বিগত আড়াই দশক যাবত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের দাবিতে প্রাণান্ত সংগ্রাম করেও বিন্দুমাত্র সফলতার মুখ দেখেনি। তাদের রাজপথ কাঁপানো প্রাণঘাতী রক্তাক্ত আন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের দ্বার উন্মোচন করতে ব্যর্থ হলেও, বিদেশী হস্তক্ষেপের পথ রুদ্ধ করতে পারেনি। কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার পালাবদলে বাংলাদেশকে সহায়তা করার ভিনদেশী প্রয়াস বেশির ভাগই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় ক্ষমতাসীন দলের এক চুল পরিমাণ ছাড় না দেয়ার নীতির কারণে।

দেশের মানুষ এটি মোটেও ভুলে যায়নি, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে, নির্বাচনকেন্দ্রিক বিবাদ মেটাতে তদানীন্তন কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার স্টেফান নিনিয়ান ১৯৯৫ সালে দীর্ঘ ৪২ দিন বাংলাদেশে অবস্থান করেন। তার সমঝোতা প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্ঘাতমুখী অবস্থানের কারণে। একইভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কলহ মেটাতে বিশেষ করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোও তাদের প্রভাব খাটাতে ঢাকায় এসেছিলেন। তারানকো ঢাকায় তার তৃতীয় সফরে একটানা ছয়দিন অবস্থান করেছিলেন। এমনকি ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে ভারতের মনোভাব বুঝতে বাংলাদেশে তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেন মজিনা নয়াদিল্লি সফর করেছিলেন। তা ছাড়া অন্যান্যের মধ্যে সাবেক জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুন, সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও ব্রিটিশ সিনিয়র মিনিস্টার সৈয়দা হোসাইন ওয়ার্সিও সমঝোতা প্রয়াসে নিজস্ব প্রভাব খাটিয়েছিলেন। তাদের সবার সমবেত প্রচেষ্টা বিন্দুমাত্র সফলতার মুখ দেখেনি।

এ ক্ষেত্রে সাবেক ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ছিলেন একমাত্র ব্যতিক্রম। নয়াদিল্লির বিশেষ বার্তা বহন করে তিনি ঢাকায় ঝটিকা সফরে এলে পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যায়। তার কার্যকর হস্তক্ষেপে অনিশ্চিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তা এক দৃষ্টান্ত পরিবর্তনকারী উদাহরণে পরিণত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল বিশেষ করে সংসদে যাদের ইতোপূর্বে প্রতিনিধিত্ব ছিল, তাদের সবাই দফায় দফায় ভারত সফর করেছিল। সফরকারী দলীয় নেতাদের সবাই ভারতের প্রকাশ্য সহায়তা কামনা করেছিলেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও সফলভাবে অনুষ্ঠানের জন্য। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভিনদেশী সহায়তা কিংবা হস্তক্ষেপের ব্যাপারে ন্যূনতম নীতিগত ঐকমত্যে বিশ্বাসী নয়। দলগুলোর প্রত্যেকটি বিগত কয়েক দশক ধরে তাদের পক্ষের শক্তিশালী ভিনদেশী রাষ্ট্র কিংবা সংস্থার প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করছে। এ ক্ষেত্রে তারা দেশের স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

পরিতাপের বিষয় এই- এসব রাজনৈতিক দলের নেতারাই বর্তমানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের বক্ত্যবের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছে, মন্ত্রিসভা থেকে তার বহিষ্কার দাবি করছে। তবে নীতিগত দুর্বলতার কারণে, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাদের এই হৈহুল্লোড় অচিরেই থিতিয়ে যাবে। কারণ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবাস্তব কিছু বলেননি। সঙ্গত কারণে দেশের উত্তেজনাপূর্ণ রাজনৈতিক মাঠও অতীতের ধারাবাহিকতায় ক্রমেই শীতল হয়ে আসবে এবং নেতারা নতুন কোনো ইস্যুর আশায় প্রহর গুনবেন।

লেখক : সাবেক বার্তা সম্পাদক, বাসস