রাজনীতিতে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট (বিএনএম)। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির সাবেক নেতাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে এই দুই দলের নতুন কমিটি। দুটি দলই সংসদের ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত সেই প্রস্তুতি দৃশ্যমান নয়। অন্য রাজনৈতিক দলের কোনো হেভিওয়েট নেতাকেও এ পর্যন্ত দল দুটিতে দেখা যায়নি।
প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার প্রতিষ্ঠিত ‘তৃণমূল বিএনপি’ নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধন পাওয়ার পরপরই তিনি মারা যান। এর পর দলটির কর্তৃত্ব বদল হয় কয়েক দফা। এখন বিএনপির সাবেক দুই নেতা দলটির নেতৃত্বে। তারা হলেন বিএনপি থেকে পদত্যাগকারী দলের ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী ও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। শমসের মবিন এখন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন এবং তৈমূর আলম খন্দকার মহাসচিব। আর নাজমুল হুদার মেয়ে অ্যাডভোকেট অন্তরা হুদা রয়েছেন দলের নির্বাহী চেয়ারপারসনের দায়িত্বে।
দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতাকর্মীর অভিযোগ, এ দলের নেতৃত্ব নাজমুল হুদার পরিবারের হাত থেকে সরে গেছে। এখন অন্তরা হুদাকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি দলের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখতে পারছেন না। গত রোববার দলের শীর্ষ দুই নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গেলেও অন্তরা হুদা ছিলেন অন্ধকারে। মনোনয়ন নিয়েও চলছে জটিলতা। তাঁকে ঢাকার দোহার আসন বাদ দিয়ে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে প্রার্থী হতে চাপ দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে বিএনপি থেকে বেরিয়ে আসা কয়েক নেতা রয়েছেন বিএনএমের নেতৃত্বে। দলটির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেনকে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করায় চলছে বিতর্ক। সারোয়ার হোসেনের অভিযোগ, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাতের আঁধারে কেন্দ্রীয় কমিটির ৭/৮ জন নিয়ে কাউন্সিল করা হয়েছে। সেখানেও চারজন ওয়াকআউট করেন। অথচ এর মাধ্যমে গঠন হয়েছে নতুন কমিটি।
এখন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর বিএনএমের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি ২০১৮ সালে ফরিদপুর-১ আসন থেকে নির্বাচন করেছিলেন। গুঞ্জন উঠেছে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ দলটির নেতৃত্বে আসছেন।
নির্বাচনের তপশিলের পর ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম। মনোনয়ন ফরম বিক্রিসহ চলছে নির্বাচনের যাবতীয় কার্যক্রম। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তৃণমূল বিএনপির এ পর্যন্ত প্রায় ১৫০টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে। তবে মনোনয়ন ফরম গ্রহণকারীর তালিকায় বিএনপি বা অন্য বড় দলের নেতাকে এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। যদিও দলটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে– দেখেন কী হয়, কারা কারা আসেন।
অন্যদিকে বিএনএমের মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু হয়েছে গতকাল সোমবার, দলের গুলশান কার্যালয় থেকে।
দল দুটি ইসি থেকে নিবন্ধন পেলেও নিবন্ধনের শর্ত পূরণ হয়েছে কিনা তা নিয়ে অনেকের মধ্যে রয়েছে সন্দেহ। অনেকে মনে করেন, সরকারের আনুকূল্যে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে এসব দলকে বিএনপির সমান্তরালে সৃষ্টি করা হয়েছে। শুরু থেকেই গুঞ্জন– বিএনপির অনেক নেতাকর্মী দল দুটিতে যোগ দিয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. শহিদুল আলম সমকালকে বলেন, ‘গত ১৮ নভেম্বর সরকারের একটি পর্যায় থেকে আমাকে ফোন করে কিংস পার্টির মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নিতে চাপ প্রয়োগ করা হয়। বলা হয়, আপনি আসেন। আপনাকে বের করে আনার দায়িত্ব আমাদের। রাজি না হওয়ায় রাতেই আমার বাসায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তল্লাশি চালায়। তারা বাসার দরজায় লাথি পর্যন্ত মারে।’ তিনি বলেন, ‘এখন আমার স্বজনকে হয়রানি করা হচ্ছে। বিষয়টি দলের হাইকমান্ডকে জানিয়েছি।’ দলের সঙ্গে বেইমানি করবেন না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
একই রকম অভিযোগ করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবু আসিফের পরিবারের সদস্যরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনের উপনির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এখন তাঁকে দলত্যাগ করার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে পরিবারের সদস্যরা জানান। তারা বলেন, বিএনপি থেকে বহিষ্কার হলেও আবু আসিফ বিএনপির রাজনীতিতেই সক্রিয় আছেন। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে আছেন তিনি।
বরগুনা জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির দাবি করেন, তাঁকে তৃণমূল বিএনপিতে যোগদানের জন্য তৈমূর আলম খন্দকারসহ আরও কয়েকজন নেতা ফোন করেছিলেন, সামনাসামনি কথা বলেছেন। বিভিন্ন প্রলোভন দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি স্পষ্ট করেছেন– বিএনপি ছেড়ে তিনি কোথাও যাবেন না। প্রশাসন থেকেও তাঁকে চাপ দেওয়া হয়েছে বলে জানান।
প্রাণহীন দলীয় কার্যালয়
রাজধানীর তোপখানা রোডে মেহেরবা প্লাজার ১৫ তলায় তৃণমূল বিএনপির কার্যালয়। প্রয়াত নাজমুল হুদার ল’ চেম্বারের একটি ছোট রুমে দুটি প্লাস্টিকের চেয়ার ও দুটি টেবিলে চলছে কার্যক্রম। অফিসে এখনও শোভা পাচ্ছে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ছবি। তার নিচেই রয়েছে নাজমুল হুদার ছবি। দেয়ালজুড়ে তিনটি বড় ছবি রয়েছে খালেদা জিয়ার। ল’ চেম্বারের পুরোটা দেয়ালে রয়েছে আইনি বই। সেখানে চলছে মনোনয়ন ফরম বিক্রি। ব্যানারের মাধ্যমে তৃণমূল বিএনপির অফিসের জানান দেওয়া হলেও সেখানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স জোটেরও নাম আছে। একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের চিরাচরিত চিত্র এখানে চোখে পড়ে না।
রাজধানীর মহাখালী এলাকার আমতলী এলাকায় বীরউত্তম জিয়াউর রহমান সড়কে মোল্লা ভবনের চার তলায় থাকা বিএনএম দলটির প্রধান কার্যালয় গুলশানে নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। তবে এর ঠিকানা পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ করেও নতুন কার্যালয়ের ঠিকানা জানা যায়নি।
সূত্র : সমকাল