বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা আইনের ফাঁদে বন্দি

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বিরোধী দলের চূড়ান্ত আন্দোলন সামনে রেখে বাড়ছে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে করা নতুন ও পুরোনো মামলার গতি। একের পর এক মামলার রায়ে সাজা ঘোষণা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে চলছে গ্রেপ্তারও। দীর্ঘদিনের পুরোনো মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে হঠাৎ সরকার তোড়জোড় শুরু করেছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি।

এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার গভীর রাতে দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সরকার পতনের দাবিতে চলমান এক দফার চূড়ান্ত আন্দোলন দমন করতে এবং নেতাকর্মীর মনোবল ভেঙে দিতে সরকার এ কৌশল নিয়েছে বলে অভিযোগ বিএনপির। অন্যদিকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলে আওয়ামী লীগের নেতা হলেও বিচারের আওতায় আনার কথা বলছে সরকার।

বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, সরকারের এমন পরিকল্পনায় গভীর রাতে দরজা ভেঙে এ্যানীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ২৩ মে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচিতে ধানমন্ডি সিটি কলেজের সামনে সংঘর্ষের ঘটনায় ধানমন্ডি থানার একটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে চার দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। অথচ ওই মামলার পর তিনি রাজনীতিতে প্রকাশ্যে সক্রিয় ছিলেন; ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। তখন কোনো অসুবিধা হয়নি। এখন যে প্রক্রিয়ায় তাঁকে আটক করা হয়েছে, যেভাবে থানাহাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন তাতে বিএনপির নেতারা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দলের নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের ঘটনা বাড়ছে। পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি এ ব্যাপারে বেশ তৎপর। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা এ্যানীকে তাঁর বাড়ি থেকে রাতে ডাকাত যে রকম করে, সেভাবে তাঁর বাড়ির দরজা ভেঙে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁকে যে পদ্ধতিতে গ্রেপ্তার করেছে, তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে এ সরকার ঠিক আগের মতো বিএনপির সক্রিয় নেতাদের গ্রেপ্তার করে একতরফা নির্বাচন করতে চায়।

সূত্র জানায়, যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করা হচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলছে, সাহস জোগাচ্ছে দলের হাইকমান্ড।

নেতারা জানিয়েছেন, নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বিরোধী দলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা-হামলা, নির্যাতন বাড়ছে। তাদের চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কোনো হাঙ্গামা না হলেও নেতাকর্মী ঘরে থাকতে পারছে না। কোনো ঘটনা ছাড়াই গত আড়াই মাসে সারাদেশে ৩৪৩ মামলা হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৩ হাজার ২৭০ জনকে এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২ হাজার ২৫০ জন। একই সময়ে পুলিশ ও সরকারি দলের হামলায় প্রায় দুই হাজার নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।

হঠাৎ পুরোনো মামলায় চলছে গ্রেপ্তার ও সাজা  

ওয়ান-ইলেভেনে দায়ের করা মামলায় গত ৩০ মে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানের রায় বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। সেই আদেশে টুকুর বিরুদ্ধে ৯ বছরের কারাদণ্ড এবং আমান উল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ১৩ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে। ওই রায়ের পর আত্মসমর্পণ করেন আমান উল্লাহ আমান। এখন তিনি  কারাগারে। অন্যদিকে মামলার রায় ঘোষণার আগে থেকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে রয়েছেন টুকু। এখনও তিনি চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছেন তাঁর ঘনিষ্ঠজন। এর আগে ভিন্ন ভিন্ন মামলায় রাজশাহী জেলা বিএনপি সভাপতি আবু সাঈদ চাঁদকে তিন বছর, যুবদল নেতা ইসহাক সরকারকে ২ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

পুরোনো রাজনৈতিক মামলাকে সক্রিয় করে দ্রুতগতিতে নিষ্পত্তির কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। অনেক মামলায় বিএনপির সিনিয়র নেতাসহ মধ্যম ও তৃণমূল নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাজার রায় ঘোষণা করেছেন আদালত। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ২০১৫ সালের একটি মামলায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, জোট নেতা আহসান হাবিব লিঙ্কন, বিএনপির গ্রাম সরকারবিষয়ক সহসম্পাদক মোহাম্মদ বেলাল আহমেদ, সহপ্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ শামীমুর রহমান শামীমসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে ৪ বছরের কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন। গত সোমবার মেট্রোপলিটনের আরেক ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বিএনপির ১০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ২০১২ সালের একটি মামলায় রায় ঘোষণা করেন। এতেও প্রত্যেককে ২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

দলীয় সূত্র জানায়, শুধু আমান ও এ্যানী নন, সম্প্রতি বিভিন্ন মামলায় কারাগারে গেছেন, বিএনপির বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমেদ, হবিগঞ্জের আহ্বায়ক ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদক জিকে গউস, সহ-ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক শফিকুল আলম মিলন, নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীর আহমেদ রবিন, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোনায়েম মুন্না, যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর, বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা শাহিন, ঢাকা উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান মোসাব্বিরসহ অনেকে।

বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, বিভিন্ন মামলায় দ্রুত সাজা দেওয়ার জন্য প্রতিদিনই বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী  সংগঠনের নেতাকর্মীর মামলার শুনানি চলছে। গত ১৮ এপ্রিল সাতক্ষীরার একটি মামলায় বিএনপির সাবেক এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ ৪ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া ৪৪ জনকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে হাবিবসহ তাদের অনেকেই কারাগারে।

বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, আইন মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষ শাখা খোলা হয়েছে। যাদের কাজ হলো বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের করা ‘মিথ্যা’ ও ‘গায়েবি’ মামলার তালিকা করে নির্দিষ্ট কিছু মামলায় দ্রুত বিচার করে সাজা দেওয়া।

‘আমি চোর না ডাকাত’

মঙ্গলবার রাত ২টার দিকে ধানমন্ডির বাসা থেকে বিএনপির প্রচার সম্পাদক এ্যানীকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে দুই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাঁকে আদালতে পাঠানো হয়। পুলিশের কাজে বাধা ও গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে ধানমন্ডি থানার মামলায় এ্যানীকে চার দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। গতকাল বুধবার ঢাকা মহানগর হাকিম রশিদুল আলম এ আদেশ দেন। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাঁকে সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক শাহিদী হাসান।

শুনানিতে এ্যানী কিছু বলবেন কিনাু বিচারক জানতে চাইলে তিনি বিচারকের সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি রাজনীতি করি। কোনো অপরাধ করলে গ্রেপ্তার করবে। কিন্তু আমাকে থানায় নিয়ে পুলিশের উপস্থিতিতে অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা কোন যুগে বাস করছি। আমি কি চোর, না ডাকাত।’

এ সময় এ্যানী আরও বলেন, ‘রাত ৩টার সময় তারা এসে আমার বাসার দরজা ভাঙছে। আমি বলেছি আমাদের বাসায় ছোট ছোট বাচ্চা আছে। আমাকে যদি গ্রেপ্তার করতেই হয়, আপনারা অপেক্ষা করুন। যেহেতু রাত ৩টা বেজে গেছে, আমি ফজরের নামাজ পড়েই আপনাদের সঙ্গে যাব। তারপরও তারা দরজা ভেঙেছে। পাঁচ মাস আগের মামলায় আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এতদিন ধরে আমি রাস্তায় ছিলাম। কয়েকবার ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ে গিয়েছি, মিটিং করেছি। তখন কেন ধরল না। রাত ৩টায় কেন আমাকে টেনেহিঁচড়ে বাসা থেকে বের করে আনবে। আমি একজন ওপেন হার্টের রোগী। আমি এর বিচার চাই।’

এ অভিযোগের বিষয়ে পিপি আবদুল্লাহ আবু আদালতকে বলেন, বিএনপি নেতা এ্যানীকে কোনো নির্যাতন করেনি পুলিশ। তাঁকে নির্যাতন করার অভিযোগ সত্য নয়। পরে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা আদালতের সামনে শহীদ উদ্দীনের মুক্তির দাবি জানিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন।

পরোয়ানা থাকলে আওয়ামী লীগ নেতা হলেও গ্রেপ্তার করা হবে: তথ্যমন্ত্রী

কারও বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলে, তিনি আওয়ামী লীগ নেতা হলেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রণালয় সভাকক্ষে চলমান বিষয়াবলি নিয়ে বাংলাদেশ সম্পাদক ফোরাম নেতাদের সাক্ষাৎ ও প্রশ্নোত্তরে তিনি এমন মন্তব্য করেন।

এ্যানীকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেছেন, তাঁকে ডাকাতের মতো ধরে নেওয়া হয়েছে এবং সরকার একতরফা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছেু এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাছান মাহমুদ বলেন, কারও বিরুদ্ধে ভাঙচুর কিংবা অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আছে, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। এটাই স্বাভাবিক। কাজেই তারা যে আইন ও বিচার মানেন না, তারই প্রমাণ হচ্ছে ফখরুলের এই বক্তব্য।

ওয়ারেন্ট থাকলে কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না: ডিবিপ্রধান  

যে পর্যায়ের নেতাই হোন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। ওয়ারেন্ট থাকলেই গ্রেপ্তার করা হবে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজই অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা। গতকাল রাজধানীর মিন্টো রোডের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ্যানীকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি এ মন্তব্য করেন।

হারুন অর রশীদ বলেন, আইন সবার জন্য সমান। তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিই হোন কিংবা অন্য কেউ। কারও বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ও সুনির্দিষ্ট মামলা থাকলে তাঁকে আইনের আওতায় আনা হবে। লক্ষ্মীপুরে এ্যানীর বিরুদ্ধে মোট দুটি ওয়ারেন্ট রয়েছে। জেলা পুলিশের অনুরোধে ধানমন্ডি মডেল থানা পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। পাশাপাশি সায়েন্স ল্যাব এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা মামলায়ও তিনি এফআইআরভুক্ত আসামি।

সমকাল