তারিকুল ইসলাম
হাইকমান্ডকে না জানিয়ে তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন বিএনপির কয়েক নেতা। এমন অভিযোগে কেন্দ্রীয় ১৬ নেতাকে নজরদারির মধ্যে রেখেছে দলটির হাইকমান্ড। তাদের নানা কর্মকাণ্ডে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ হচ্ছে।
দলের একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, নজরদারিতে থাকা নেতাদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, বিএনপির ভেতরে থেকে দলের ক্ষতির চেষ্টা করছেন তারা। বিশেষ একটি গোষ্ঠীর পক্ষ হয়ে ‘সরকার পতন’র পাশাপাশি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ‘মাইনাস’ করে বিএনপির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
বিশেষ করে সম্প্রতি বিভিন্ন ব্যানারে জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন ও গোপন বৈঠকসহ বেশ কিছু কর্মসূচিতে দলের কয়েক নেতা অংশ নিয়েছেন। তাদের ব্যাপারে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। তাদের ধারণা, ১/১১-এর সময়ে যেসব নেতা দলের মূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে সংস্কার প্রস্তাব এনেছিলেন তাদের বড় একটি অংশ এবং সাবেক ছাত্র নেতাদের একটি অংশ এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত।
সূত্র জানায়, বিএনপির সাত ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা চারজন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী, এক শিক্ষক নেতা, সংরক্ষিত আসনের সাবেক এক এমপিসহ ১৬ কেন্দ্রীয় নেতার কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখছে হাইকমান্ড।
যারা বিভিন্ন ব্যানারে বেশ কিছু দিন ধরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে নানা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। এ তালিকায় রয়েছেন স্থায়ী কমিটির এক প্রভাবশালী সদস্যও। এর বাইরেও মুক্তিযোদ্ধা দলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন ও ঢাকা মহানগর বিএনপির আরও অন্তত ১২ নেতা তালিকায় রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরের একজন তরুণ নেতাও আছেন। এদের সঙ্গে কথা বলার জন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি অনেককে ফোন করে সতর্কও করেছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, একটা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী কখনই দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে পারে না। এটা তো একটা ডিসিপ্লিনের মধ্যে আছে। আমাদের মধ্যে নানা ডিফারেন্স অব অপিনিয়ন হতে পারে, সেটা হাউসের মধ্যে। ওপেন কোনো জায়গায় তো আমরা কোনো কথা বলতে পারি না। আমরা যদি দল বা দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সম্পর্কে প্রকাশ্যে বলি, তাহলে জনগণ কী ভাববে? এটা তো হতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে সাংগঠনিক কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায়, সে বিষয়ে গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে।
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, গুঞ্জন রয়েছে সরকার পতনের দাবিতে গত কয়েক দিন ধরে বিএনপি, জামায়াত ও বাম দলসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী কিছু নেতা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। এজন্য তারা ১৪ ডিসেম্বর (সোমবার) দিনটিকে বেছে নেন। এ খবর বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছলে সেখান থেকে কঠোর বার্তা আসে।
কেউ যেন এ কর্মসূচিতে অংশ না নেন সেজন্য প্রতিটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদেরও বার্তা দেয়া হয়। দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে সোমবার দুপুরে পল্টন-গুলিস্থান এলাকায় কিছু দলীয় নেতাকর্মী জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন। ওই বিক্ষোভে শওকত মাহমুদসহ কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। এমন কর্মসূচিতে অংশ নেয়ায় দলের পক্ষ থেকে শওকত মাহমুদকে আর বিক্ষোভ কর্মসূচির প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে শোকজ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। এর আগে গত বছর সুপ্রিমকোর্ট সড়কের সামনে হঠাৎ করে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে একই কর্মসূচি পালন করা হয়েছিল।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, দলের শোকজের চিঠি পেয়েছি। চিঠির উত্তর প্রস্তুত করছি। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে নিজের অবস্থান তুলে ধরব। এক্ষেত্রে দল থেকে পদত্যাগ করার বিষয়টি কি সামনে আসবে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, চিন্তা-ভাবনা করছি। সংবাদ সম্মেলনেই বিস্তারিত জানাব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য যুগান্তরকে জানান, এক-এগারোর পর থেকে জিয়া পরিবারের মধ্যে সংস্কারবিরোধী ভাবনাটি প্রবল হয়। ওই সময়ের বিপর্যয়ের পর থেকে সংস্কার-ধারার সক্রিয় কোনো নেতাকেই দলের গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি কাজে খুব একটা নিযুক্ত করা হয়নি। সেই সংস্কারপন্থীদের মধ্যে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন সামনের কাতারে।
আর এ চিন্তাটিও দলের শীর্ষ নেতৃত্বে সব সময়ই কাজ করেছে। যদিও পরে গত কয়েক বছরে দলের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যুক্ত হওয়ার পরামর্শ দেয়া হলেও হাফিজ উদ্দিন এতে আগ্রহ দেখাননি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দলের একটি ক্ষুদ্র অংশ শীর্ষ নেতৃত্বের বাইরে গিয়ে নানা ধরনের ‘বিতর্কিত’ কার্যক্রমে যুক্ত হয়। এ কারণেই আগেভাগে সতর্ক করতেই শোকজ করা হয়েছে দুই সিনিয়র নেতাকে।