বিএনপির অগ্রাধিকার নির্বাচন, জামায়াত চায় সংস্কার

বিএনপির অগ্রাধিকার নির্বাচন, জামায়াত চায় সংস্কারজাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের রূপরেখা না থাকায় বিএনপি ও সমমনা দলগুলো আশাহত হওয়ার কথা বললেও জামায়াতে ইসলামী সংস্কারে জোর দেওয়ায় আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। বিএনপি নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিলেও জামায়াত ভোটের আগে সংস্কার চায়।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে গত রোববার জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত বললেও নির্বাচনের দিনক্ষণ স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তিনি বলেছেন, তড়িঘড়ি নির্বাচনের চেয়ে টেকসই সংস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে নির্বাচন কয়েক মাস পেছালেও ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হবে।

ভাষণের দিনই প্রচারিত আলজাজিরায় সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সাধারণত নিয়মিত সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। মানুষ সরকারের মেয়াদ কম চায়। সংবিধানে নতুন করে চার বছরের প্রস্তাব করা হচ্ছে। তবে তা নির্ভর করছে মানুষ কী চায়, রাজনৈতিক দলগুলো কী চায়– তার ওপর।’
তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে চার বছর থাকছেন কিনা– প্রশ্নে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমি তা বলিনি যে চার বছর। আমি বলেছি, এটি সর্বোচ্চ মেয়াদ হতে পারে। তবে আমাদের উদ্দেশ্য তা নয়। আমাদের উদ্দেশ্য যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা।’

আলজাজিরায় সাক্ষাৎকার প্রচারের পর গুঞ্জন ছড়ায়, অন্তর্বর্তী সরকার চার বছর ক্ষমতায় থাকতে পারে। যদিও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব তা খণ্ডন করে বলেন, সংবাদমাধ্যমে ড. ইউনূসের বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব সূত্রের খবর, তারা চান নির্বাচন নির্ধারিত সময়ে,

অর্থাৎ ২০২৯ সালের জানুয়ারিতে হোক। তাদের ব্যাখ্যা, শেখ হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত ডামি নির্বাচন খ্যাত ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ভোটকে বিএনপি-জামায়াতসহ অধিকাংশ বিরোধী দল তখনকার বাস্তবতা মেনে আন্দোলনের ইতি টেনেছিল। ছাত্ররা অভ্যুত্থান করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত না করলে ২০২৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা ছাড়া পথ ছিল না রাজনৈতিক দলগুলোর। তাই সেই পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করুক দলগুলো।

অভ্যুত্থানে সর্বাত্মক অংশ নেওয়া বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মী জীবন দিয়েছেন। আহত হয়েছেন হাজারো। ১৫ বছর আন্দোলন, জেল-জুলুমে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করতে না পারা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও মানছেন ‘গোলে শেষ লাথি’ দিয়েছে ছাত্ররাই।
তা মানলেও দ্রুততম সময়েই নির্বাচন চায় বিএনপি। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘ভাষণ ভালো হয়েছে। অনেকে আশান্বিত হয়েছেন। আমি একটু আশাহত হয়েছি। আমি আশা করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা তাঁর সব প্রজ্ঞা দিয়ে সমস্যাটা চিহ্নিত করে নির্বাচনের জন্য একটা রূপরেখা দেবেন।’

কেন বিএনপি দ্রুত নির্বাচনে গুরুত্ব দিচ্ছে– এ ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘কেন নির্বাচনের কথা বারবার বলছি কারণ, নির্বাচন দিলে অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বিএনপি ক্ষমতায় যাক না যাক, বিষয় নয়। যারা বাংলাদেশের ক্ষতি করতে চাইছে, স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চাইছে, সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে, নির্বাচনের রূপরেখা দিলে তারা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হবে।’

ইউনূস সরকারের সামনে অতীতের নজিরও তুলে ধরেছেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেছেন, এতটা সময় যেন না নেয়, তা জনগণে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হবে যে, আপনি (ড. ইউনূস) ক্ষমতায় থেকে যেতে চাইছেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের সরকার কিংস পার্টি করার চেষ্টা করেছিল। ক্ষমতায় থেকে দল করার বিষয়টি মানুষ মেনে নেয়নি। তারা নির্বাচন দিয়ে পালিয়েছিল, তাই না।

সোমবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় সংস্কার প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, সংস্কারের দাবি বিএনপিই তুলেছে। সরকারের কাছে অনুরোধ, যেভাবে এগোলে সুন্দর হয়, গ্রহণযোগ্য হয়, সেভাবে এগিয়ে যান। এখন পর্যন্ত বাধার সৃষ্টি করিনি; বরং প্রতিটি ক্ষেত্রে সমর্থন দিচ্ছি। যদিও সচিবালয়ে এখনও স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের দোসররা বসে আছে।

গত মাসে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জামায়াত নেতারা জানিয়েছিলেন, সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ চান। তবে সে জায়গা থেকে দলটিকে সরে এসে সংস্কারে জোর দিতে দেখা যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার একই আভাস দেন।

তিনি সমকালকে বলেছেন, নির্বাচনের দিকে যাত্রা যে শুরু হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে তা স্পষ্ট হওয়ায় জাতি কিছুটা হলেও আশ্বস্ত। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, অত্যাবশ্যকীয় কিছু সংস্কারের পরেই নির্বাচন দেবেন। জামায়াত এর সঙ্গে একমত। সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে যাওয়ার জন্য অনেকেই তাড়াহুড়ো করছেন। এতে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। আবার সেই ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালের মতো নির্বাচন হবে। ন্যূনতম সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনের চিন্তাকে জামায়াত সমর্থন করে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রায় পুরোটা জুড়ে ধরপাকড় এবং ঘোষিত-অঘোষিত নিষিদ্ধ অবস্থায় থাকা জামায়াতের একাধিক নেতার ভাষ্য, আওয়ামী লীগ না থাকায় তারাই এখন বিএনপির প্রধান প্রতিযোগী। যদিও জামায়াতের এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই দলটির চাওয়া, আগে সংস্কারের মাধ্যমে এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা তৈরি হোক, যাতে ভবিষ্যতে বিরোধী দলগুলোকে আওয়ামী লীগ আমলের মতো নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে না হয়।

একজন নেতা সমকালকে বলেছেন, ২০১০ সাল থেকে জামায়াতের নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ সমর্থকেরও সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকার দূরে থাক, মানবাধিকারও ছিল না। ভবিষ্যতে যাতে এ পরিস্থিতিতে না পড়তে হয়, তাই সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। আগামীর সরকার ক্ষমতা সুসংহত করতে এ কাজ নাও করতে পারে।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সরকার চার বছরের প্রসঙ্গটি তুলে বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়েছে। গণতন্ত্র উত্তরণে নির্বাচনের বিকল্প নেই। তাই যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হবে, ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের পথনকশার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক বার্তা নেই। আলজাজিরায় ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকারে নির্বাচন নিয়ে বাস্তবিক প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। এতে দেশের মানুষের কাছে নির্বাচন নিয়ে অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। এতে ধারণা জন্মাতে শুরু করেছে, সরকার হয়তো অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থাকতে চায়। এই বিভ্রান্তি নিরসনে কখন-কীভাবে নির্বাচন হবে, সেই রূপরেখা দেওয়া দরকার।

অভ্যুত্থানের অংশীদার এবি পার্টির সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতের দূরত্ব থাকলেও সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার গুঞ্জন রয়েছে। দলটির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু সমকালকে বলেছেন, মাত্র ২২ দিনের অভ্যুত্থানে যে শক্তির ঐক্যে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে, সেই শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে দেড়-দুই বছরে সংস্কার এবং নির্বাচন করা সম্ভব।

১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, সরকার হয়তো চার বছর ক্ষমতায় থাকছে চাইছে। কিন্তু ম্যান্ডেট তাদের কে দিয়েছে? অন্তর্বর্তী সরকার জরুরি প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব নিয়েছে। মৌলিক কিছু সংস্কার করে তারা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন– এটাই প্রত্যাশা।

samakal