জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গনেও নতুন মেরূকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আন্দোলনরত রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনের তপশিল প্রত্যাখ্যান করায় নির্বাচনে অংশ নিতে জোর প্রস্তুতি শুরু করেছে ‘কিংস পার্টি’ নামে পরিচিত দলগুলো। বিএনপির সাবেক ও বর্তমান ক্ষুব্ধ নেতাদের দলে টেনে এমপি হওয়ার ‘টোপ’ দিচ্ছে তারা। ইতোমধ্যে তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ফোরাম এবং স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ নামে নতুন চারটি দলে যোগও দিয়েছেন কেউ কেউ।
সর্বশেষ বিএনএম নামের দলটিতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম ও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান যোগ দিতে পারেন বলে দাবি করছেন দলটির নেতারা। নাটকীয় কিছু না ঘটলে শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে দলটিতে যোগ দিয়ে মেজর হাফিজ চেয়ারম্যান এবং সাকিবকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের পদে দেখা যেতে পারে বলে জানান তারা। নতুন নিবন্ধিত দলের মহাসচিব হচ্ছেন বাংলাদেশ মানবাধিকার ব্যুরোর মহাসচিব ড. মোহাম্মদ শাহজাহান।
বিএনএম মহাসচিব ড. মোহাম্মদ শাহজাহান
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে এক নেতার নিজ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিএনএমের কাউন্সিলে পূর্বের ৩১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে গঠনতন্ত্র মোতাবেক ২০১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় ও ১৭ সদস্যদের জাতীয় স্থায়ী কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কাউন্সিলে ১০০টি পদ পূরণ করা হয়েছে। দলটির চেয়ারম্যান ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের পদসহ অন্যান্য পদ খালি রাখা হয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে। এত দিন দলটির আহ্বায়ক ছিলেন বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক ড. আবদুর রহমান এবং সদস্য সচিব ছিলেন বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য ও দলের চেয়ারপারসনের সাবেক প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মেজর (অব.) মোহাম্মদ হানিফ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনএমের আহ্বায়ক কমিটির কয়েক নেতা সমকালকে জানিয়েছেন, গত মঙ্গলবার দলের আগের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে গুলশানে নতুন কার্যালয় নেওয়া হয়েছে। এখান থেকেই দলটি নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের অভিযোগ, দলের ৩১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটির মধ্যে মাত্র ৮ জন ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) এহতেশামুল হকসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে কাউন্সিল নামে গোপন বৈঠকে রাখা হয়নি। এমনকি নতুন কমিটিতেও তাদের রাখা হচ্ছে না। মেজর (অব.) হাফিজের পছন্দের লোকদের দিয়ে কমিটি হচ্ছে। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বিএনএম দলটি আত্মপ্রকাশ করেছে বলেও দাবি করেন তারা। সময় ও সুযোগ হলেই তিনি যোগ দিতে পারেন। অবশ্য অভিযোগ কিছুটা অস্বীকার করেছেন দলটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব। তারা বলেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের উপস্থিতিতে কাউন্সিল অধিবেশনে সব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
বেশ কিছুদিন ধরে মেজর হাফিজকে নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছে। দীর্ঘদিন ধরে দলের ভেতর যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছেন না বলে ক্ষুব্ধ তিনি। কিছুদিন আগে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে কারণ দর্শাও নোটিশও দেওয়া হয়েছে। নোটিশের তিনি জবাব দিলেও দল থেকে তাঁকে এখনও কিছু জানানো হয়নি।
সম্প্রতি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, হাফিজ শিগগিরই নতুন দলে যোগ দেবেন। গত বৃহস্পতিবার অনেক দল ও ব্যক্তির নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইঙ্গিত করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘সামনের সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৩০ নভেম্বর মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার শেষ তারিখ। এর মধ্যে কত ফুল ফুটবে! আর শীতকাল তো এসে গেছে। কিছু কিছু ফুল ফোটার সময়ও এসে গেছে। এখন কোন ফুল কোথায় ফুটছে, হঠাৎ জেগে উঠবে। অপেক্ষা করুন।’
গত ৮ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে নতুন দলে যোগদানের কথা অস্বীকার করে রাজনীতি থেকেই অবসর নেওয়ার ঘোষণা দেন মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ। চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবেন বলে জানান তিনি। একই সঙ্গে বিএনপিকে বিদেশিদের মধ্যস্থতায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যাওয়া উচিত বলে জানান এই নেতা। এর পর বিগত এক সপ্তাহ প্রকাশ্যে আর কিছু বলেননি তিনি।
বিএনএমের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবদুর রহমান ও সদস্য সচিব মেজর (অব.) মোহাম্মদ হানিফ সমকালকে বলেন, আমাদের দল নির্বাচনে যাবে। কয়েক দিনের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে। দলে মেজর হাফিজ এবং সাকিব যোগ দিচ্ছেন কিনা– জানতে চাইলে এ মুহূর্তে কারও নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তিনি। শুধু বলছেন, বিএনপি থেকে উল্লেখযোগ্য সাবেক এমপি এবং অনেক খ্যাতিমান, এমনকি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তির তাদের দলে যোগ দেওয়ার বিষয়ে কথাবার্তা চলছে।
দলের মুখপাত্র ব্যারিস্টার সরোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, তিনি শুনেছেন, দলের বৈঠক হয়েছে। নতুন কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এর বাইরে কিছু বলতে রাজি নন তিনি।
এ ছাড়া ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত অপর দলগুলোর মধ্যে বিএনপির সাবেক নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল বিএনপি অন্যতম। সম্প্রতি এ দলে যোগ দিয়ে চেয়ারম্যান হয়েছেন শমসের মবিন চৌধুরী ও মহাসচিব অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। শমসের মবিন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এবং তৈমূর আলম চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সদস্য।
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে তৈমূর আলম খন্দকার সমকালকে জানান, তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন। বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও শ্রেণি-পেশার নেতাকর্মী যোগ দিচ্ছেন এবং আরও দেবেন। তিনি আরও বলেন, তারা জোট করে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
গত ১৪ অক্টোবর বিএনপি চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সাবেক সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) সাবেক ভিপি নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ফোরাম’ নামে নতুন একটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। দলটির চেয়ারম্যান হন নাজিম; মহাসচিব হয়েছেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট থেকে চাকসুর সাবেক জিএস আজিম উদ্দিন। নতুন দল দুটিতে বিএনপির পদবঞ্চিত সাবেক নেতাকর্মী যোগ দেবেন বলে দাবি করছেন তারা।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে গত ১৫ নভেম্বর ‘স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ’ নামে নতুন একটি জোট গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির দুই সদস্য খন্দকার আহসান হাবিব ও ফখরুল ইসলাম। অবশ্য জোট ঘোষণার পরপরই বিএনপি থেকে বহিষ্কার হন এ দুই নেতা।
সমকাল