ঘটনার শুরু
২৩ জানুয়ারি। বইমেলার আমন্ত্রণপত্র ততক্ষণে প্রস্তুত। সংস্কৃতি বিষয়ক সচিব আবুল মনসুর বাংলা একাডেমিতে আসেন এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র দেখে ‘ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া’ ব্যক্ত করেন। আমন্ত্রণপত্রের শেষ পৃষ্ঠায় আয়োজনের জায়গায় বাংলা একাডেমির পাশাপাশি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের লোগো সংযুক্ত করে নতুন করে আমন্ত্রণপত্র ছাপার নির্দেশ দেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলা একাডেমির এক কর্মকর্তা জানান, পরবর্তীতে ২৪ জানুয়ারি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী আমন্ত্রণপত্রে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মনোগ্রাম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম ব্যবহার করে বাংলা একাডেমিকে আমন্ত্রণপত্র ছাপানোর মৌখিক নির্দেশ দিলে সেভাবেই সংশোধন করা হয়।
মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের দায় কার?
ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে লেখক সাহিত্যিক মহলে প্রশ্ন ওঠে কার্ডের ওপরে বিকাশের লোগো বসানো নিয়েও। উল্লেখ্য, বাংলা একাডেমি আইন ২০১৩-তে বলা হয়েছে, ‘একাডেমি একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হইবে এবং ইহার স্থায়ী ধারাবাহিকতা ও একটি সাধারণ সিলমোহর থাকিবে এবং এই আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে ইহার স্থাবর ও অস্থাবর উভয় প্রকার সম্পত্তি অর্জন করিবার, অধিকারে রাখিবার ও হস্তান্তর করিবার ক্ষমতা থাকিবে।’
ইতোমধ্যে লেখক সাহিত্যিকরা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, বাংলা একাডেমি আইনের ৩-এর ২ ধারা মোতাবেক বাংলা একাডেমি একটি সংবিধিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবে কার্যনির্বাহী পরিষদ। এই পরিষদে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একজন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন সদস্য থাকবেন। এছাড়া থাকবেন একাডেমির মহাপরিচালকসহ শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের অন্য সদস্যরা। কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হলে তারাই নেবেন। কোনও অবস্থাতেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব একাডেমির অভ্যন্তরীণ কোনও বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।
এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নুরুল হুদাকে টেলিফোনে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি। পরে খুদেবার্তায় বিষয়টি জানানো হলেও উত্তর দেননি।
বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমি এ বিষয়ে অবহিত নেই। তবে এটা যদি কবি নুরুল হুদা করে থাকেন তবে সেই দায় তারই। এই দুটো লোগো অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে তাকে অবহিত করার কথা কিনা জানতে চাইলে সেলিনা হোসেন বলেন, করার কথা, তবে করেননি।
তবে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব নিয়ে মন্তব্য না করার কথা জানিয়ে বলেন, আমি বিব্রত। আমি সরকারি চাকরি করি। এসব ওপরের বিষয়ে কথা বলতে আমি প্রস্তুত নই।
এদিকে সাবেক মহাপরিচালক মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ বৃহস্পতিবার দুপুরে দেওয়া একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘একুশের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আসবেন দেশের সরকার প্রধান, সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি। মহাপরিচালক স্বাগত ভাষণ দেবেন। মন্ত্রী বিশেষ অতিথি থাকবেন এই ছিল নিয়ম আমার মেয়াদে ১৯৯১-১৯৯৫ পর্যন্ত। …সচিবদের কখনও একুশের আয়োজন তদারকি করতে দেখিনি। এটা একান্তই কাউন্সিল এবং মহাপরিচালকের এখতিয়ারে। আমন্ত্রণপত্রে মন্ত্রণালয়ের নাম বা লোগো থাকার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না।’
প্রতিষ্ঠানে দুর্বলতা থাকলে এমন হয়
স্বায়ত্তশাসন রক্ষায় মহাপরিচালক নুরুল হুদার অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ কিনা—এমন প্রশ্নে বিবৃতিদাতাদের একজন কবি ও শিক্ষক খালেদ হোসাইন বলেন, একটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের এক ধরনের চারিত্রিক দৃঢ়তা থাকে। মনে হয় না বিষয়টা একপাক্ষিক ঘটেছে। যারা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে এসে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছেন, তাদের এই পক্ষ থেকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে বলেও আমি মনে করি। এই সুযোগ দেওয়ার দায় তাদের আছে। এই স্বায়ত্তশাসনের সৌন্দর্য রক্ষায় দৃঢ়তার দরকার আছে। ওখানে যারা আছেন তাদেরও সোচ্চার হতে হবে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, এর আগে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কোনোভাবেই যুক্ত থাকতো না। এটা বাংলা একাডেমির আয়োজন। আমার কথা হলো, যদি সরকারই যুক্ত হয় তাহলে আর সহযোগিতায় বিকাশের দরকারটা কী?
এদিকে যেকোনও প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন রক্ষার প্রথম দায়িত্ব সেই প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদেরই উল্লেখ করে বাংলা একাডেমির মতো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে সরকার কী দৃষ্টিতে দেখতে চায় সেটা যেমন স্পষ্ট হতে হবে, ঠিক তেমনি নিজ মর্যাদা রক্ষায় প্রতিষ্ঠানের অবস্থান স্পষ্ট হতে হবে উল্লেখ করে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যেকোনও প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদার রাখার দায়িত্ব সরকারের না, প্রতিষ্ঠানের ওপর। যখন কিনা স্বায়ত্তশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য থেকে শুরু করে শিক্ষকরা সরকার দলীয় রাজনীতিতে নাম লেখান ও সরকারদলীয় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে নিয়ে চলেন, তখন সেই স্বায়ত্তশাসন নষ্ট হওয়ার পিছনে আমরাই দায়ী। যেকোনও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রাখার দায়িত্ব সরকারের যতটা, তার থেকে বেশি সেই প্রতিষ্ঠানের। বাংলা একাডেমি কি সেভাবে তা মেনে চলে? কেবল ভিন্নমত এসে যাবে সেই শঙ্কায় বছরের পর বছর নির্বাহী কমিটিতে নির্বাচন হয় না। বাংলা একাডেমি ভুলে গেছে, শিল্প-সাহিত্যে ভিন্নমতের উপস্থিতি জরুরি। আমরা আশা করি, বাংলা একাডেমি যদি কোনও কর্পোরেটের আর্থিক সহায়তা নিয়েও থাকে তবু যেন তাদের লোগো-বিজ্ঞাপন ব্যবহারে বিরত থাকে। মৌখিকভাবে বাংলা একাডেমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে, সেটি মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।