ভাস্কর্য বিতর্ক: এবার হেফাজতে ইসলামের আমীর জুনাইদ বাবুনগরী স্বয়ং কঠোর বক্তব্য তুলে ধরলেন

BBC News Bangla

জুনাইদ বাবুনগরী

ছবির ক্যাপশান,জুনাইদ বাবুনগরী

এবার কড়া ভাস্কর্য-বিরোধী অবস্থান ব্যক্ত করলেন হেফাজতে ইসলামের আমীর জুনাইদ বাবুনগরী।

এ কদিন বাংলাদেশে মামুনুল হক নামে একজন ইসলামী নেতার ভাস্কর্য-বিরোধী অবস্থান উত্তাপ ছড়াচ্ছিল, যার সর্বশেষ সংযোজন হিসেবে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় শুক্রবার ভাস্কর্যের পক্ষে-বিপক্ষে কিছু বিক্ষোভ দেখা যায়।

ঢাকায় বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে বলপ্রয়োগও করতে হয়।

এরকম পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে পূর্বনির্ধারিত একটি ইসলামিক অনুষ্ঠান বা ওয়াজ মাহফিলে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরতও থাকেন মামুনুল ইসলাম, যিনি নিজে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব।

সেই একই অনুষ্ঠানে গিয়ে জুনাইদ বাবুনগরী বললেন, “আমি কোন পার্টির নাম বলছি না, কোন নেতার নাম বলছি না…. কেউ যদি আমার আব্বার ভাস্কর্য স্থাপন করে, সর্বপ্রথম আমি আমার আব্বার ভাস্কর্যকে ছিঁড়ে, টেনে-হিঁচড়ে ফেলে দেব”।

শুক্রবার সন্ধ্যাবেলা চট্টগ্রামের হাটহাজারীর একটি স্কুল মাঠে তিন দিনের একটি ওয়াজ মাহফিলের সমাপনী অনুষ্ঠানে একথা বলেন মি. বাবুনগরী।

২০১৪ সালে এক বক্তৃতায় শেখ হাসিনা বাংলাদেশে মদিনা সনদ বাস্তবায়ন করা হবে বলে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেই বক্তব্যের কথা মনে করিয়ে দিয়ে জুনাইদ বাবুনগরী বলেন, “মদিনা সনদে যদি দেশ চলে, তাহলে কোন ভাস্কর্য থাকতে পারে না”।

“মদিনা সনদে যদি দেশ চলে, ইসলামবিরোধী কোন কাজ হতে পারবে না… ইনশাআল্লাহ প্রধানমন্ত্রী দেবে না, দেবে না। কারণ উনি নিজে ঘোষণা করেছেন মদিনা সনদে দেশ চলবে।”

তবে তিনি এও বলেন, তিনি বা তার সংগঠন কোন রাজনৈতিক সংগঠন নয়, তারা সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও নয়।

আহমদ শফী
ছবির ক্যাপশান,প্রয়াত আহমদ শফী, হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমীর

যেভাবে বিতর্কের শুরু:

প্রায় দুই মাস ধরে ঢাকার ধোলাইপাড় চত্বরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য তৈরি করার পরিকল্পনার বিরোধিতা করে আসছিল অনেকগুলো ইসলামপন্থী দল।

অক্টোবরের শুরু থেকেই ভাস্কর্য তৈরির প্রতিবাদে বেশ কয়েকটি দল ঢাকার কয়েকটি জায়গায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করেছে।

কিন্তু খেলাফত মজলিশের নেতা মামুনুল হক গত তেরই নভেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবর রহমানের ভাস্কর্য তৈরির তীর্ব্র সমালোচনা করেন। পনেরাই নভেম্বর এক সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব নির্বাচিত হন মি. হক।

তিনি সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, ভাস্কর্য নির্মাণ পরিকল্পনা থেকে সরে না দাঁড়ালে তিনি আরেকটি শাপলা চত্বরের ঘটনা ঘটাবেন এবং ওই ভাস্কর্য ছুঁড়ে ফেলবেন। তার ওই বক্তব্য সরকারি দল আওয়ামী লীগে অস্বস্তি তৈরি করে।

এরপর আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখালেও দলটির সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, তারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন।

এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুরু করে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে।

ঢাকায় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয়ভাবেও সামবেশ করে ভাস্কর্যের বিরোধীতাকারীদের উচিৎ জবাব দেবার হুমকি দিয়েছে।

এর ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবারই চট্টগ্রামে জঙ্গিবাদবিরোধী সমাবেশ থেকে মামুনুল হকের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয় এবং শুক্রবার তাকে চট্টগ্রামে প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়া হয়।

ঘোষণা অনুযায়ী শুক্রবার চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচী পালিত হয়েছে।

এই কর্মসূচীর জবাবে ঢাকায় ইসলামপন্থীরা একটি বিক্ষোভ দেখালে তা ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ।

জুনায়েদ বাবুনগরী শুক্রবার সন্ধ্যায় এক ঘন্টারও বেশি সময় ধরে দেয়া বক্তব্যে মূলত ভাস্কর্য ইস্যু নিয়েই কথা বলেন। এছাড়া আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক, বয়কট ফ্রান্স এবং কাদিয়ানি ইস্যু নিয়েও কথা বলেন।

তিনি বক্তব্য শেষ করেন, যারা গতকাল মামুনুল হকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছে তাদেরকে অভিসম্পাত দেয়ার মধ্যে দিয়ে।

বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে এর আগেও ভাস্কর্য তৈরির বিরোধিতা এবং ভাস্কর্য অপসারণের দাবি এসেছে।

তিন বছর আগে ২০১৭ সালে ঢাকায় সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে গ্রীক দেবীর আদলে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছিল। হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থী কয়েকটি সংগঠনের বিরোধিতার মুখে সেই ভাস্কর্য সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল।

কে এই জুনায়েদ বাবুনগরী?

হেফাজতে ইসলামের নতুন নেতা তিনি।

সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা আহমদ শফীর মৃত্যুর দুমাস পর গত ১৫ই নভেম্বর এক সম্মেলনে মি. বাবুনগরী হেফাজতে ইসলামের আমীর নির্বাচিত হন।

এর আগে তিনি সংগঠনের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন। কিন্তু উত্তরাধিকার নির্বাচন নিয়ে আহমদ শফির সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

আহমদ শফির মৃত্যুর আগেই তাদের বিরোধ চরম আকার ধারণ করে।

এক পক্ষে জুনায়েদ বাবুনগরী ও অন্য তরফে আহমেদ শফীর ছেলে আনিস মাদানী তাদের অনুসারীদের নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান।

সতেরোই নভেম্বর হেফাজত ইসলামের সম্মেলনটি আনিস মাদানী ও তার অনুসারীদের বাদ দিয়েই করা হয়েছিল।

ব্লগারদের বিরুদ্ধে ঢাকার মতিঝিলে শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে হেফাজতে ইসলাম আলোড়ন তুলেছিল ২০১৩ সালে।

এরপর সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আমীর আহমদ শফীর সাথে সরকারের সখ্যতা গড়ে ওঠে।।

গত কয়েক বছর ধরে সরকারের সাথে সখ্যতার প্রশ্নে সংগঠনটিতে পক্ষে-বিপক্ষে দু’টি ধারার সৃষ্টি হয়েছিল।

কারণ সরকার-বিরোধী বিভিন্ন ইসলামপন্থী দলের নেতারাও সংগঠনটিতে রয়েছেন।