বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের পাওয়ার প্লে

logo

ভারত ভূষণ

২০ জুন ২০২৩, মঙ্গলবার

mzamin

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বৈরিতা এখন ভারতের ঠিক পাশেই বাংলাদেশে চলছে। সরকার সমালোচকদের বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য দায়ী দেশটির র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর বিরুদ্ধে কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে চীন প্রকাশ্যে শেখ হাসিনা সরকারকে সমর্থন করেছে। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় হস্তক্ষেপকারীদের ভিসা প্রত্যাখ্যান করার হুমকি দেয়ার পরও (চীনের) এই সমর্থন এসেছে।

চীনা বিবৃতি এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক গেম-চেঞ্জার হতে পারে যা কেবল ভারতের ‘লুক ইস্ট পলিসি’ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকেও প্রভাবিত করতে পারে। গত ১৪ই জুন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অফিসিয়াল সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমস-এর প্রতিবেদক দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিনের কাছে নিষেধাজ্ঞা এবং সরকার পতনের মার্কিন ক্ষমতা সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘সাম্প্রতিক’ বিবৃতিগুলো সম্পর্কে চীনের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের নাম না নিয়েই ওয়াং বলেন, ‘… একটি নির্দিষ্ট দেশ [যুক্তরাষ্ট্র] দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অজুহাতে বাংলাদেশ ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে আসছে।’ আধিপত্যবাদ ও ক্ষমতার রাজনীতি প্রতিরোধে চীন বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশকে সাহায্য করতে প্রস্তুত মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি।’

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের যুদ্ধে বাংলাদেশ নতুন এক যুদ্ধক্ষেত্র হবে বলে মনে হচ্ছে।
যাই হোক, চীনের মাত্রাতিরিক্ত ঘোষণার কার্যকরী তাৎপর্য স্পষ্ট নয়। কোনো দেশই তার আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার ব্যাপারে অন্য কোনো দেশকে আশ্বাস দিতে পারে না, যদি না সেই দেশের ভূখণ্ডে তার প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ব্যবহারের ব্যবস্থা থাকে। বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি নয়। কিংবা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সুবিধার্থে যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টাও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বা আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য হুমকিস্বরূপ নয়। সুতরাং, চীনের ঘোষণার অর্থ হলো ২০২৪ সালের নির্বাচন যেভাবেই হোক না কেন দেশটি শেখ হাসিনার পাশে থাকবে।

যতদিন আওয়ামী লীগ সরকার ভারতীয় স্বার্থ রক্ষা করছে ততদিন বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান চীনা পদচিহ্ন নিয়ে ভারত তুলনামূলকভাবে নীরব। শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ ভারতকে নিরাপত্তা ইস্যুতে সাহায্য করেছেÑ বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে।

সড়ক, রেল, নদী এবং সাগরের মাধ্যমে ভারতকে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় তিন রাজ্য ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং আসামে ট্রানজিট রুটের অনুমতি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং চারটি নদীপথের মাধ্যমে কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ আসাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এর বাইরে বিবিরবাজার থেকে শ্রীমন্তপুর (ত্রিপুরা) হয়ে আখাউড়া থেকে আগরতলা (ত্রিপুরা) হয়ে শেওলা থেকে সুতারকান্দি (আসাম) হয়ে এবং তামাবিল থেকে ডাউকি (মেঘালয়) হয়ে এখন আন্তঃসীমান্ত ট্রাক চলাচল করতে পারে। 

পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশি ট্রাক, ট্রেন এবং জাহাজ ব্যবহার করা হবে বলে উভয় দেশই পণ্য পরিবহন বৃদ্ধির সুফল পাবে। বাংলাদেশ ট্রানজিট ফি আদায় করবে এবং রপ্তানি বাড়াতে ভারতীয় ঋণের আওতায় নির্মিত পরিবহন অবকাঠামো ব্যবহার করবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই সম্পর্ককে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ‘সুবর্ণ অধ্যায়’ বলে বর্ণনা করেছেন।
যদিও ভারতের ‘পাবলিক পজিশন’ এমন ছিল যে, তারা বাংলাদেশের জনগণ দ্বারা নির্বাচিত যেকোনো সরকারের সঙ্গে কাজ করবে, কিন্তু (নির্বাচন যেভাবেই পরিচালিত হোক না কেন) গত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে তারা দৃঢ়ভাবে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিই সমর্থন রেখেছিল। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য বাংলাদেশের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়া (যে অভিযোগ রয়েছে) নিয়ে খোলাখুলি প্রশ্ন তুলেছে।

চীন যে এখন দৃঢ়ভাবে শেখ হাসিনাকে সমর্থন করছে তা নিয়ে ভারতের কি দুশ্চিন্তা করা উচিত? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, আগস্ট মাসে ঢাকা ব্রিকস সম্মেলনে অতিথি হিসেবে যোগ দেবে। অন্য আটটি দেশের সঙ্গে ওই গ্রুপিংয়ে যোগ দেয়ার জন্য তাকে (তখন) সম্ভবত আমন্ত্রণ জানানো হবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং মার্কিন ডলারের আধিপত্য মোকাবিলায় একটি নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থা তৈরি করাই ব্রিকসের লক্ষ্য।
ব্রিকস-এ বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়াবে তা কেউই অনুমান করতে পারছেন না। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই চাইনিজ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এবং বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার (বিসিআইএম) অর্থনৈতিক করিডোরের অংশ হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বাংলাদেশে ভারতের অনেক বেশি, তাৎক্ষণিক কৌশলগত অংশীদারিত্ব রয়েছে: নিজের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করা, উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে অ্যাক্সেস ও ট্রানজিট এবং চিকেনস নেক বা শিলিগুড়ি করিডোরকে রক্ষা করে বাকি অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোকে সংযুক্ত করা। তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, আখাউড়া-সিলেট রেললাইন এবং সিলেট ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরে চীনা বিনিয়োগের কারণে কৌশলগত স্বার্থের ক্ষেত্রে চীন মুক্তভাবে কাজ করায় নিজের উত্তর-পূর্বে ভারতের প্রবেশাধিকার প্রভাবিত হতে পারে।
বিদেশি শক্তি এবং তাদের প্রক্সিদের সম্ভাব্য ভূমিকা ভারতের জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ হিসেবে রয়ে গেছে। মণিপুরে উত্তাপ, মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী চীনের ইউনান প্রদেশের রুইলিতে নাগা বিদ্রোহীরা আশ্রয় পাচ্ছে এবং মিয়ানমারের সাগাইংতে বেশ কয়েকটি উত্তর-পূর্ব বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতারা লুকিয়ে আছে। কক্সবাজারের পেকুয়ায় বিএনএস শেখ হাসিনা সাবমেরিন ঘাঁটিতে চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মির নাবিকদের অনুমিত উপস্থিতি (যেখানে তিনটি চীনা সাবমেরিন বার্থ করা হবে) ভারতকেও উদ্বিগ্ন করবে।

স্বল্পমেয়াদে ভারত এমন দাবি করতে পারে যে, ঢাকায় বন্ধুত্বপূর্ণ সরকারকে সমর্থন করা ভিন্ন তার কাছে অন্য বিকল্প নেই। কিন্তু, আগামী সাধারণ নির্বাচনের সময় শেখ হাসিনার বয়স হবে ৭৬ বছর। ভারতকে পরবর্তী প্রজন্মের নেতাদের সঙ্গে কাজ করার নীতি গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া, বাংলাদেশের জনগণের মেজাজও বিবেচনা করতে হবে, যা কিনা দ্রুত ভারত বিরোধী হয়ে উঠছে। ফের যদি ভারতকে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ফলাফলকে সমর্থন করতে দেখা যায়, তবে সেটির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

শেখ হাসিনার প্রতি নিজ প্রতিশ্রুতির কারণে ভারত হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দাঁড়িয়েছে এমনটা দেখাতে চায় না, কিন্তু সমভাবে বাংলাদেশে চীনা আধিপত্য বিস্তারের জন্য ভারত জায়গাও ছেড়ে দিতে পারে না। সুতরাং, বাংলাদেশের বিষয়ে আরও সৃষ্টিশীল কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে ভারতকে। যাই হোক, ভারতীয় কূটনীতিকে অবসাদে পেয়ে বসেছে বলে মনে হচ্ছে, যদিও ভারতের অসুবিধার জন্য চীনের দাবার বোর্ডটি সেখানে পুনরায় সেট করা হচ্ছে।

[বিশিষ্ট ভারতীয় সাংবাদিক ভারত ভূষণের লেখাটি ১৯শে জুন দেশটির ইংরেজি দৈনিক বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এ প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন তারিক চয়ন]