ইসমাইল আলী:
গত বছর এপ্রিল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি শুরু করে ভারতের আদানি। কোম্পানিটির ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্র থেকে নিয়মিতই এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। এতে ভারতের আদানি পাওয়ার ২০২৩-২৪ হিসাব বছর (এপ্রিল-মার্চ) প্রচুর আয় করেছে। এর ওপর ভিত্তি করে আদানির মুনাফায় বড় উল্লম্ফন হয়েছে। শেষ হওয়া হিসাব বছরে আদানি পাওয়ারের আয় বেড়েছে প্রায় ৩৭ শতাংশ ও মুনাফা বেড়েছে ৯৪ শতাংশ।
আদানি পাওয়ারের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, ভারতের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আদানি পাওয়ারের আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ৯৬০ কোটি রুপি (৬৭ হাজার ২৩ কোটি টাকা)। এর মধ্যে ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্র থেকে আয় হয়েছে সাত হাজার ৩৭০ কোটি রুপি বা প্রায় ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এটি মোট আয়ের ১৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
২০২২-২৩ হিসাব বছরে আদানি পাওয়ারের আয়ের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ২৬৮ কোটি রুপি বা ৪৯ হাজার ১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদায়ী হিসাব বছরে আদানি পাওয়ারের আয় বেড়েছে ১৩ হাজার ৬৯২ কোটি রুপি বা ১৮ হাজার আট কোটি টাকা। অর্থাৎ বর্ধিত আয়ের অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেছে আদানি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হিসাব বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আয় বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মুন্দ্রা বিদ্যুৎকেন্দ্র, নতুন উৎপাদনে আসা গড্ডা কেন্দ্র, উদুপি ও মহন প্লান্ট। ভারতের অভ্যন্তরে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া এবং আমদানিকৃত কয়লা ও বিকল্প জ্বালানির দাম হ্রাস পাওয়ায় মুনাফা বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্য, বেশি আয় ও সেই তুলনায় খরচ কম হওয়ায় এত মুনাফা হয়েছে। এছাড়া মার্চেন্ট গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি ও গড্ডার অপারেটিং মুনাফা শেষ প্রান্তিকে মুনাফা বাড়াতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
এদিকে গত হিসাব বছরে আদানি পাওয়ারের মুনাফা আগের বছরের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৮২৯ কোটি রুপি বা ২৭ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা। এর আগের (২০২২-২৩) হিসাব বছরে কোম্পানির মুনাফার পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৭২৭ কোটি রুপি। এছাড়া ২০২১-২২ হিসাব বছরে আদানি পাওয়ার মুনাফা করে চার হাজার ৯১২ কোটি রুপি ও ২০২০-২১ অর্থবছর এক হাজার ২৭০ কোটি রুপি। এর আগের দুই বছর আদানি পাওয়ার লোকসানে ছিল। এর মধ্যে ২০১৯-২০ হিসাব বছর দুই হাজার ২৭৫ কোটি রুপি ও ২০১৮-১৯ হিসাব বছর ৯৮৪ কোটি রুপি লোকসান গুনে কোম্পানিটি।
আদানি পাওয়ারের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করে এক হাজার ৪৬৮ কোটি রুপি, দ্বিতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দুই হাজার ৩৪ কোটি রুপি, তৃতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) এক হাজার ৮২৪ কোটি রুপি ও চতুর্থ প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দুই হাজার ১৪৪ কোটি রুপি। অর্থাৎ জানুয়ারি-মার্চ সময়ে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। যদিও এ সময় শীতের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা তুলনামূলক কম থাকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রির জন্য গত বছর ৫ এপ্রিল গড্ডা কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ও ২৬ জুন দ্বিতীয় ইউনিটটি উৎপাদন শুরু করে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চুক্তির আওতায় কেন্দ্রটি থেকে লম্বা সময় ধরে (২৫ বছর) বিদ্যুৎ বিক্রি করা হবে।
প্রসঙ্গত, আদানির সঙ্গে যখন চুক্তি হয় তখন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১২ হাজার ৯২২ মেগাওয়াট এবং সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ৯ হাজার ৫০৭ মেগাওয়াট। তবে আদানি যুক্ত হওয়ার সময় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৩৩২ মেগাওয়াট ও সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। মূলত বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ও দেশের উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারতের দিকে ঝুঁকে। যদিও এ চুক্তি নিয়ে শুরু থেকেই নানা বিতর্ক রয়েছে।
এদিকে উদ্বৃত্ত সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশের নিজস্ব কেন্দ্র বসিয়ে রেখে আদানি থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। কারণ আদানির সঙ্গে চুক্তির শর্তে বলা হয়েছে, গড্ডা কেন্দ্রটির সক্ষমতার একটি নির্দিষ্ট অংশের কম বিদ্যুৎ কেনা হলে বাংলাদেশকে উল্টো জরিমানা দিতে হবে। এছাড়া কেন্দ্রটির জন্য উচ্চহারে ক্যাপাসিটি চার্জও দিতে হচ্ছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত এক বছরে আদানি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে প্রায় ৩৭ দশমিক ৭৫ কোটি ডলার বা চার হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি।
প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, গড্ডা প্লান্ট চালু হওয়ার পর আদানি পাওয়ারের পরিচালন ক্ষমতা ও বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এবং আমদানি করা জ্বালানি পণ্যের দাম কম হওয়ায় তাদের আয় বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ইবিআইটিডিএ (সুদ, কর, অবচয় ও পরিশোধনের আগে আয়) শেষ প্রান্তিকে এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২৬ শতাংশ বেড়ে পাঁচ হাজার ২৭৩ কোটি রুপি হয়। আগের হিসাব বছরের শেষ প্রান্তিকে এটি ছিল দুই হাজার ৩২৯ কোটি রুপি।
গত বছর আদানি পাওয়ারের ইবিআইটিডিএ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৭৮৯ কোটি রুপি। আগের হিসাব বছরে এটি ছিল আট হাজার ৫৪০ কোটি রুপি। অর্থাৎ ২০২৩-২৪ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ইবিআইটিডিএ বেড়েছে ১২০ শতাংশ। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিনের কাজ কতটা ভালোভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা ইবিআইটিডিএর মাধ্যমে জানা যায়।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৪ এপ্রিল বাণিজ্যিকভাবে কার্যক্রম শুরুর পর ৩০ জুন পর্যন্ত প্রায় তিন মাসে প্রতিষ্ঠানটি ১৫৯ কোটি ৮০ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ (কিলোওয়াট ঘণ্টা) বাংলাদেশে বিক্রি করেছে আদানি। এ বিদ্যুৎ কেনায় বাংলাদেশি মুদ্রার হিসাবে প্রতি ইউনিটে খরচ হয়েছে ১৪ টাকা দুই পয়সা। যদিও চলতি অর্থবছর তা কমে ১৩ টাকায় নেমে আসতে পারে বলে মনে করছে বিপিডিবি।
sharebiz