বাংলাদেশের সভরেন ক্রেডিট রেটিং (সার্বভৌম ঋণমান) অবনমন করেছে আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষায় এতদিন দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিং ছিল ‘বিবি মাইনাস’ (BB-)। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের এ ঋণমান কমিয়ে ‘বি প্লাস’ (B+) করে দেয়া হয়েছে। তবে স্বল্প মেয়াদে ঋণমান অপরিবর্তিত (B) রাখার পাশাপাশি আউটলুক ‘স্থিতিশীল’ রেখেছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার বিষয়টি ভবিষ্যতে নীতি পদক্ষেপগুলোর কার্যকারিতা সংক্রান্ত পূর্বাভাস দেয়াকে কঠিন করে তুলতে পারে বলে এসঅ্যান্ডপির বক্তব্যে উঠে আসে। এতে বলা হয়, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে টানা চতুর্থবারের মতো সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ নির্বাচন বয়কট করেছিল। ঐতিহাসিকভাবে প্রধান এ দুই দলের মধ্যে তীব্র বিরোধ রয়েছে। সংসদে সরকারকে বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয় খুবই সামান্য। এজন্য সরকারের কার্যক্রমে জবাবদিহিতা বা ভারসাম্য আনার সুযোগও সীমিত।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাত দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনে দুই শতাধিক মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে বর্তমানে বেশ কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আদালতের রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের পর এ আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনের জবাবে সরকার টেলিকমিউনিকেশন ব্ল্যাকআউট ও দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে। এরপর ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট অধিকাংশ কোটা বাতিল করে রায় ঘোষণা করেন।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের ভাষ্যমতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে পতনের ধারা অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের বহিস্থ চাপ মোকাবেলায় তারল্য সক্ষমতা কমে আসার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ২০২৪ সালের মে মাসে গৃহীত সামষ্টিক অর্থনীতির নীতিপদক্ষেপগুলো (যেমন বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ নীতির বাস্তবায়ন, টাকার অবমূল্যায়ন ও কঠোর মুদ্রানীতির প্রয়োগ) এ চাপ কিছুটা প্রশমন করতে পারে, তবে সেটিও ঘটতে পারে ধীরে ধীরে। একই সঙ্গে এখানে সুদ ব্যয়ের অনুপাত অনেক বেশি। বাজেট ঘাটতির আকার সংকোচনের ধারায় থাকলেও এখনো অনেক বড়, যা এসঅ্যান্ডপির আর্থিক মূল্যায়নে প্রভাব ফেলেছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এসঅ্যান্ডপি বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি সভরেন ক্রেডিট রেটিং বা ঋণমান ‘বিবি মাইনাস’ থেকে কমিয়ে ‘বি প্লাসে’ নামিয়ে এসেছে। একই সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি ঋণমান নামিয়ে আনা হয়েছে ‘বি’-তে। তবে বহিরাবরণের দিক থেকে সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে।
সংস্থাটির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের রফতানি প্রোফাইল অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট পণ্য রফতানির ৮৫ শতাংশের বেশি জুড়ে রয়েছে তৈরি পোশাক। এখানকার রফতানি খাত যেসব সুবিধা পায় তার ৭০ শতাংশই স্বল্পোন্নত দেশের জন্য নির্ধারিত অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা। সংস্কারের অভাবে বা নতুন অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে রফতানি আয়ে পতনের আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া বিদেশী বিনিয়োগও ধারাবাহিকভাবে নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ক্রমপরিবর্তনশীলতা, কাঠামোগত সংকট ও আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতার প্রতিফলন বলে মনে করছে এসঅ্যান্ডপি।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের ভাষ্যমতে, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং উচ্চ উৎপাদন ব্যয় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন অবকাঠামোয় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা পোশাক উৎপাদন শিল্পকেও চাপে ফেলে দিচ্ছে। এসঅ্যান্ডপি মনে করছে, আগামী তিন-চার বছর অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্রুত প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখতে এ ধরনের অবকাঠামোর উন্নয়ন জরুরি।
এর আগে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে এসঅ্যান্ডপির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং আউটলুক বা ঋণমানের আভাস নেতিবাচক করে দেয়া হয়েছিল। সংস্থাটির পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, রিজার্ভ, বিদেশী ঋণ ও তারল্য পরিস্থিতির ছন্দপতন হলে, বাংলাদেশের সার্বভৌম রেটিং অবনমন করা হবে। পূর্বাভাস দেয়ার এক বছরের মাথায় এসে তা অবনমন করল এসঅ্যান্ডপি।
এসঅ্যান্ডপি ছাড়াও মুডি’স এবং ফিচ রেটিংসও গত এক বছরে বাংলাদেশের ঋণমান অবনমন করেছে। গত বছরের ৩১ মে বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে ‘বিএ৩’ থেকে ‘বি১’-এ নামিয়ে দেয় মুডি’স। আর ফিচ রেটিংস চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান অবনমন করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ফরেন কারেন্সি ইস্যুয়ার ডিফল্ট রেটিং (আইডিআর) ‘বিবি মাইনাস’ থেকে ‘বি প্লাস’-এ নামিয়ে দেয়া হয়।
এসঅ্যান্ডপি, মুডি’স ও ফিচ রেটিং—যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ তিন ঋণমান নির্ধারণী প্রতিষ্ঠান একত্রে ‘বিগ থ্রি’ হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের ক্রেডিট রেটিং বাজারের সিংহভাগই এ প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। এ তিন প্রতিষ্ঠানের রেটিংয়ের ওপর কোনো দেশের অর্থনৈতিক দৃঢ়তা, বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বাণিজ্য আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পায়। ঋণমানের অবনমন ঘটানোর অর্থ হলো বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা আগের চেয়ে দুর্বল হয়েছে।
আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী তিন রেটিং প্রতিষ্ঠান ঋণমান কমিয়ে দেয়ায় বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি তথা বৈদেশিক বাণিজ্যের শর্তগুলো এখন কঠিন হয়ে পড়ছে। ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গিয়ে দেশের ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত ফি গোনার পাশাপাশি আরো কঠিন শর্তের মুখে পড়তে হচ্ছে। একই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের সুদও বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্বের সুপরিচিত বৃহৎ ব্যাংকগুলো বাংলাদেশী ব্যাংকের জন্য নিজেদের ক্রেডিট লাইন বা ঋণসীমা কমিয়ে দিচ্ছে বলে জানা গেছে।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরের ভাষ্যমতে, ‘এসঅ্যান্ডপি আগেই বাংলাদেশের আউটলুক নিয়ে নেতিবাচক বার্তা দিয়েছিল। এখন পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ঋণমান অবনমন করে দিয়েছে। এর আগে মুডি’স ও ফিচ রেটিং বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়েছে। বিশ্বের প্রভাবশালী তিন রেটিং প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই ঋণমান অবনমনের ঘোষণা দুঃখজনক।’
বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ঋণমান অবনমনের ফলে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যয় বেড়ে গেছে। বিদেশী কোনো ব্যাংকের নিশ্চয়তা ছাড়া বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে পারছে না। এ নিশ্চয়তা প্রাপ্তির জন্য ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সে ব্যয়ের বোঝা শেষ পর্যন্ত দেশের সাধারণ মানুষের ওপরই পড়ছে। বিদেশীরা যে কোনো দেশের ঋণমান দেখে বিনিয়োগ কিংবা ঋণ দেয়। ঋণমান দুর্বল হলে বিদেশী বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়। বিদেশী ঋণের সুদহারও বেড়ে যায়।’
আন্তর্জাতিক ঋণমান প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবার আগে বাংলাদেশের ঋণমান অবনমন করেছিল মুডি’স ইনভেস্টরস সার্ভিস। ২০২৩ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ অবনমন করা হয়। মুডি’স জানায়, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন উঁচুমাত্রার দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে চলমান সংকটের মধ্যে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। এ কারণে মুডি’স বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে বিএ৩ থেকে বি১-এ নামিয়ে দেয়া হয়। তবে বাংলাদেশের জন্য মুডি’স তাদের পূর্বাভাস স্থিতিশীল রাখে। যদিও স্বল্পমেয়াদি ইস্যুয়ার রেটিংয়ের ক্ষেত্রে ‘নট প্রাইম’ বা শ্রেষ্ঠ গুণসম্পন্ন নয়, এমন মান অব্যাহত রাখার কথাও জানায় তারা।
এ ঘটনার পর ওই বছরের জুনে মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘এই রেটিং কমানোর বিষয়ে আমাদের বিশেষ কিছু আসে-যায় না। এটা করার পেছনে ভূরাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার আছে।’
গত সেপ্টেম্বরে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা ইস্যুয়ার ডিফল্ট রেটিং (আইডিআর) স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচক করে দেয় ফিচ রেটিংস। এরপর চলতি বছরের মে মাসে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান অবনমন করা হয়। ‘বিবি মাইনাস’ থেকে অবনমন করে ‘বি প্লাস’ রেটিং দেয় ফিচ রেটিংস।
এলসি খোলা ও বিদেশী ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংকগুলোকে আগের চেয়ে অনেক বেশি জটিলতা ও শর্তের মধ্যে পড়তে হচ্ছে বলে দেশের অন্তত চারটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন। তারা বলছেন, ‘কান্ট্রি রেটিং খারাপ হওয়ায় আমাদের এলসিতে বেশি ফি গুনতে হচ্ছে। অনেক বিদেশী ব্যাংক এলসি খুলতে নানা ধরনের শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। বিদেশী ব্যাংকগুলো আমাদের ক্রেডিট লাইন কমিয়ে দিয়েছে। মেয়াদ শেষ হওয়া বিদেশী ঋণ নতুন করে নবায়ন করা যাচ্ছে না। কেউ নবায়ন করলেও সেটির সুদহার বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বিদেশীরা বলছে, তোমাদের দেশের রেটিংই তো খারাপ। দেশের রেটিং খারাপ হলে দরকষাকষির সুযোগ থাকে না।’
Bonik Barta