বাংলাদেশেই অধ্যাপক হওয়া সবচেয়ে সহজ

বাংলাদেশেই অধ্যাপক হওয়া সবচেয়ে সহজ

শরীফুল আলম সুমন

  kalerkantho

২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯

বাংলাদেশেই অধ্যাপক হওয়া সবচেয়ে সহজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে শিক্ষকের সংখ্যা ৪৯। এর মধ্যে কর্মরত ৩৬ জন, বাকি ১৩ জন রয়েছেন শিক্ষাছুটিতে। কর্মরত শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপকের সংখ্যা ২২। আর সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক মিলিয়ে কর্মরত ১৪ জন। তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগে কর্মরত অধ্যাপকের সংখ্যা ৯ এবং অন্যান্য পদে রয়েছেন ছয়জন। দর্শন বিভাগে কর্মরতদের মধ্যে অধ্যাপকের সংখ্যা ১১ এবং অন্যান্য পদে রয়েছেন ১০ জন। মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত অধ্যাপকের সংখ্যা ২২, অন্যান্য পদে রয়েছেন ১৪ জন। আইন বিভাগে কর্মরতদের মধ্যে অধ্যাপক রয়েছেন ১৯ ও অন্যান্য পদে ১৭ জন। ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপক ছয়জন ও অন্যান্য পদে রয়েছেন তিনজন।

এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগেই সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক এই তিন পদের চেয়ে অধ্যাপকের সংখ্যা বেশি। দেশের বড় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা প্রায় একই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক বিভাগেই এখন অন্যান্য পদের শিক্ষকের চেয়ে অধ্যাপকের সংখ্যা বেশি। অনেক শিক্ষকই প্রশাসনিক পদ-পদবি পেয়ে নিজে যে একজন শিক্ষক সে পরিচয় ভুলে যান। গবেষণা হচ্ছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক কাজ। পদোন্নতির জন্য গবেষণা, না মৌলিক গবেষণা তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে।’

জানা যায়, অধ্যাপক হওয়া সবচেয়ে সহজ হচ্ছে বাংলাদেশে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক বিভাগেই অধ্যাপকের চেয়ে অন্য তিন পদের শিক্ষকের সংখ্যা কম। কারণ গবেষণা, প্রকাশনা থাকুক আর নাই থাকুক বাংলাদেশে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের পর একটা নির্দিষ্ট সময়ে তিনি অধ্যাপক হয়ে যান।

সূত্র জানায়, সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্রিটিশ ও আমেরিকান নিয়মে নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়ে থাকে।

আগে বাংলাদেশে ব্রিটিশ নিয়ম চললেও এখন চলছে আংশিক আমেরিকান নিয়মে। ব্রিটিশ নিয়মানুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে প্রথমে যোগদান করতে হবে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। এর পরের পদ রিসার্চ ফেলো, তারপর লেকচারার, সিনিয়র লেকচারার। এই পর্যন্ত আসতে একজন শিক্ষকের প্রয়োজন হয় সাত থেকে আট বছর। এর পরের পদ রিডার এবং তারপর অধ্যাপক। এভাবে অধ্যাপক হতে পর্যাপ্ত গবেষণা ও পাবলিকেশনস থাকার পরও ২০ থেকে ২৫ বছর সময় লাগে। অনেকেই রিডার পদ থেকেই অবসরে যান।

আমেরিকান নিয়ম অনুযায়ী যোগদানের পদ প্রভাষক, এরপর সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক। তবে ওপরের পদে পদোন্নতি পেতে হলে পদ শূন্য অথবা সৃষ্ট হতে হবে। একই সঙ্গে মানসম্পন্ন গবেষণা ও প্রকাশনা থাকতে হবে। এভাবে একজন শিক্ষককে অধ্যাপক হতে হলে ২০ থেকে ২২ বছর সময় লাগে। অনেকেই সহযোগী অধ্যাপক পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়ে অবসরে চলে যান।

সাধারণত বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অধ্যাপকের বিপরীতে তিনজন সহযোগী অধ্যাপক, পাঁচজন সহকারী অধ্যাপক এবং প্রভাষক থাকেন কমপক্ষে সাতজন। এমনকি প্রতিটি পদে থাকার সময় তাঁর গবেষণা ও পাবলিকেশনস থাকতে হবে। সেটা না থাকলে তাঁর চাকরিই থাকবে না। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র ঠিক উল্টো।

নাম প্রকাশ না করে একজন উপাচার্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এখন প্রভাষক হওয়ার বয়সটা ধরি ২৪ বছর। তাঁর যদি কিছু প্রকাশনা থাকে, তাহলে তিনি ৩৬ বছর বয়সে অধ্যাপক হয়ে যাচ্ছেন। তাঁর চাকরির বাকি ২৯ বছর তাঁকে একই পদে থাকতে হয়। এমনকি অধ্যাপক হওয়ার পর চাকরি স্থায়ী করতে একটি পাবলিকেশনসের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এরপর তিনি গবেষণা করলেন কি করলেন না সে ব্যাপারে কোনো নিয়ম নেই। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বাড়ছে না।’

জানা যায়, বাংলাদেশে প্রভাষক পদে যোগদানের পর সহকারী অধ্যাপক হতে সময় লাগে তিন বছর। সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক হতে সময় লাগে পাঁচ বছর। তবে পিএইচডি ও প্রকাশনা না থাকলে সময় লাগে ছয় থেকে সাত বছর। সহযোগী থেকে অধ্যাপক হতে সময় লাগে কমপক্ষে চার বছর। তবে পিএইচডি ও প্রকাশনা না থাকলে সময় লাগে পাঁচ থেকে ছয় বছর। যদি একজন শিক্ষকের যথাসময়ে পিএইচডি ও সব ধরনের প্রকাশনা থাকে তাহলে তিনি সর্বনিম্ন ১২ বছরেই অধ্যাপক হতে পারেন। তবে কোনো প্রকাশনা না থাকলেও ১৭ থেকে ১৮ বছরে একজন শিক্ষক অধ্যাপক হতে পারেন। সব ক্ষেত্রেই পদ থাকা না থাকা কোনো সমস্যা নয়।

বাংলাদেশের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় বিশ্বের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে আমাদের শিক্ষকরা মর্যাদা পাচ্ছেন না। ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল কাদের দ্বীপ দেশ ফিজির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে শিক্ষকতা করছেন। তিনি যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করেন তখন তাঁর বিভাগে তিনজন সিনিয়র লেকচারারের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিল তৃতীয়।

তবে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির জন্য একটি অভিন্ন গাইডলাইন করে দিয়েছে। কিন্তু সেটা এখনো কার্যকর করেনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় তারা নিজ নিয়মেই চলছে। অভিন্ন গাইডলাইনে বলা হয়েছে, অধ্যাপক হতে হলে কমপক্ষে ১২টি প্রকাশনা থাকতে হবে। পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে ১২ বছর, এমফিল ডিগ্রি থাকলে ১৭ বছরে অধ্যাপক হওয়া যাবে। তবে কোনো উচ্চতর ডিগ্রি না থাকলে প্রভাষক থেকে অধ্যাপক হতে ২১ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এ ছাড়া প্রতিটি পদোন্নতিতে প্রকাশনার সংখ্যা আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে।

ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আখতার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা উচ্চশিক্ষার মান উন্নীত করতে চাই। এ জন্য শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে আমরা একটা গাইডলাইন ঠিক করে দিয়েছি। দেখা যায়, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতিতে দুটি প্রকাশনা থাকলেই হয়, আবার কোনোটিতে ১০টা। আমরা চাই, সব জায়গায় একটা নির্দিষ্ট মানদণ্ড থাকুক।’

ইউজিসি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে কয়েক বছর ধরেই বলছে, অনেক শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নেন না বা শিক্ষার্থীদের নোটিশ না দিয়ে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকেন। একজন শিক্ষককে প্রতি সপ্তাহে কত ঘণ্টা ক্লাস নিতে হবে—এ ব্যাপারে নিজস্ব নিয়ম থাকলেও এর বাস্তবায়ন হয় না। অনেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিক সময় ব্যয় করেন।

শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের সময় অধ্যাপক পদটা খুবই সীমিত ছিল। এ জন্য সাধনা করতে হতো। এখনকার শিক্ষকদের আগের মতো অভিজ্ঞতা ও প্রকাশনা লাগে না। জ্ঞানচর্চায়ও সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আসলে শিক্ষার্থী সংখ্যা ও পাসের হার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় নয়, ওই বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ও প্রকাশনায় কতটা সমৃদ্ধ সেটাই তাদের আসল পরিচয়।’