বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র রেন্টাল ও আইপিপির (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়েই চলেছে। তবে গত অর্থবছর এ খাতে ব্যয় এক লাফে ২৫ শতাংশের বেশি বাড়ে। অথচ এ সময় আইপিপি ও রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ব্যবহার কমেছে। স্বাভাবিকভাবে সক্ষমতার ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ উৎপাদন করার শর্তে লাইসেন্স দেয়া হয় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছর সক্ষমতার মাত্র ৩৮ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে, যা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ইতিহাসে সর্বনিম্ন।
পিডিবির তথ্যমতে, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা গত অর্থবছর বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। যদিও এর মধ্যে ৮১৯ মেগাওয়াট রয়েছে এনইএনপি (নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট) এবং ৪৫৬ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র। এসব কেন্দ্রের জন্য কোনো ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় না। এরপরও গত অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৭ হাজার ১৫৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। যদিও উৎপাদন সক্ষমতার ৬২ শতাংশ বসে ছিল গত অর্থবছর।
এদিকে ২০২১-২২ অর্থবছর রেন্টাল ও আইপিপিগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১০ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট। ওই অর্থবছর সক্ষমতার ৪৭ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। আর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছিল ১৩ হাজার ৭০০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ব্যবহার কমেছে ৯ শতাংশীয় পয়েন্ট। অথচ ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়েছে তিন হাজার ৪৫৫ কোটি ১১ লাখ টাকা বা ২৫ দশমিক ২২ শতাংশ।
বেসরকারি খাতের রেন্টাল ও আইপিপির বাইরে গত অর্থবছর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে ৬৩২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। তবে এ চার্জ আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার অর্ধেকের জন্য এবং মাত্র তিন মাসের (এপ্রিল-জুন)। কারণ গত এপ্রিল থেকে আদানির ঝাড়খণ্ডের বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। এ হিসাবে আদানির পুরো কেন্দ্রটি (দুই ইউনিট) পূর্ণ সক্ষতায় চালুর ফলে চলতি অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
সূত্রমতে, গত ১৫ বছরে বেসরকারি খাতে ১০০টির বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র দরপত্রের মাধ্যমে নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়। যদিও একটিমাত্র কোম্পানি দরপত্র জমা দেয়ায় তাতেও কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। ফলে প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি দরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের লাইসেন্স দেয়া হয়। বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল আনসলিসিটেড তথা অযাচিত প্রস্তাবের মাধ্যমে। ফলে এগুলোর নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে অনেক বেশি। ফলে ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে প্রতি বছর নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। সক্ষমতা বাড়ছে জাতীয় গ্রিডের। যদিও সেগুলোর অর্ধেকও ব্যবহার করা হয় না। তবে ক্যাপাসিটি চার্জ ঠিকই পরিশোধ করতে হবে। ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১৫ বছরের ক্যাপাসিটি চার্জের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৩৩৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অথচ ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে ৬৩ হাজার ৪৫২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর বেসরকারি খাতের সক্ষমতা ছিল পাঁচ হাজার ৭৪১ মেগাওয়াট। ওই অর্থবছর কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার ৫৪ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় আট হাজার ৭২২ কোটি ২৭ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়ায় আট হাজার ৪১১ মেগাওয়াট। যদিও করোনার কারণে সাধারণ ছুটি থাকায় ওই অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক কমে যায়। এজন্য সক্ষমতার মাত্র ৩৯ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। তবে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৮৫২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৭৩৪ মেগাওয়াট। এর ৪৬ শতাংশ ব্যবহার করা হলেও ওই বছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় ১৩ হাজার ২১ কোটি তিন লাখ টাকা। আর ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় যথাক্রমে ১৩ হাজার ৭০০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ও ১৭ হাজার ১৫৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র যুক্ত হচ্ছে গ্রিডে। সক্ষমতা বাড়ায় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বাড়ছে। এছাড়া ক্যাপাসিটি চার্জ ডলারের বিনিময় হার ধরে টাকায় পরিশোধ করতে হয়। এতে টাকার অবমূল্যায়নেও দেশীয় মুদ্রায় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়েছে।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ছিল এক হাজার ৭২০ মেগাওয়াট। সে বছর সক্ষমতার ব্যবহার হয় ৬৮ শতাংশ এবং ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় এক হাজার ৫০৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৮৭৮ মেগাওয়াট। সে বছর সক্ষমতার ব্যবহার হয় ৬৯ শতাংশ এবং ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় এক হাজার ৭৯০ কোটি ২০ লাখ টাকা।
২০১০-১১ অর্থবছর বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ১৬২ মেগাওয়াট। সে সময় সক্ষমতার ৫৪ শতাংশ ব্যবহার হয় এবং ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় দুই হাজার ৭৮৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। পরের (২০১১-১২) অর্থবছর বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা আরও বেড়ে হয় তিন হাজার ৫৮৩ মেগাওয়াট, যার ৫৮ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। সে অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় ছিল পাঁচ হাজার এক কোটি ২৩ লাখ টাকা।
২০১২-১৩ অর্থবছর সক্ষমতা সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৬৮৫ মেগাওয়াট। সে বছরও সক্ষমতার ৫৮ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। আর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় পাঁচ হাজার ৪৯০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছর বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা চার হাজার মেগাওয়াট ছাড়ায়। তবে ব্যবহার হয় ৫২ শতাংশ। সে অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল চার হাজার ৭১৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
২০১৪-১৫ অর্থবছর বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ৪৪৮ মেগাওয়াট, যার ৫০ শতাংশ ব্যবহার হয়। ওই অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় চার হাজার ৬৬৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছর সক্ষমতা পাঁচ হাজার মেগাওয়াট ছাড়ায়। এর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল পাঁচ হাজার ৩৭৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। তবে সক্ষমতার ৫৩ শতাংশ ব্যবহার করা হয়।
২০১৬-১৭ অর্থবছর বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা আরও বেড়ে হয় পাঁচ হাজার ৪৫৯ মেগাওয়াট। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পরিশোধ করা হয় পাঁচ হাজার ৭৬৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। তবে সক্ষমতার ব্যবহার হয় ৫১ শতাংশ। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছর কয়েকটি রেন্টাল কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ২১৩ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় ছয় হাজার ২৪১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। তবে সক্ষমতার ৫৫ শতাংশ ব্যবহার করা হয়, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
শেয়ার বিজ