বগুড়া উপনির্বাচন
তাহলে এই নির্বাচন কমিশনও পারে!
বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ আওয়ামী লীগ প্রার্থীর চেয়ে ৫৭ হাজার ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, এটি অবিশ্বাস্য ঘটনা নয়। বরং ফলাফল উল্টো হলেই অবিশ্বাস্য মনে হতো। আবার এখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী টি জামান নিকেতা যে ৩২ হাজার ভোট পেয়েছেন, তাতে প্রমাণ করে না যে সারা দেশে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিএনপির কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবেন।
বহু বছর ধরে বগুড়া বিএনপির শক্ত ঘাঁটি। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বগুড়ার সাতটি আসনই বিএনপির দখলে ছিল; যেমন গোপালগঞ্জের সব আসন আওয়ামী লীগ পেত, এখনো পাচ্ছে, ভবিষ্যতেও পাবে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মহাবিজয়ের সময়ও বিএনপি বগুড়ায় পাঁচটি আসন ধরে রেখেছিল। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি বগুড়ায় দুটি করে আসন পায়। একটি পান স্বতন্ত্র প্রার্থী।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে এই আসনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পেয়েছিলেন ২ লাখ ৫ হাজার ৯৮৭ ভোট এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম ওমর পান ৩৯ হাজার ৯৬১ ভোট। বগুড়ার সাংবাদিক বন্ধুরা বলেছেন, ৩০ ডিসেম্বর বগুড়া-৬ আসনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। অন্যান্য আসনে বিরোধী দলকে নানাভাবে নাজেহাল করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু দলীয় সংহতির স্বার্থে মির্জা ফখরুল শপথ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে আসনটি শূন্য হয়ে যায়। যদিও বিএনপির অপর সাত বিজয়ী প্রার্থী শপথ নিয়েছেন এবং সংসদেও গিয়েছেন।
বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচন বিশ্লেষণ করলে আমরা যেসব বৈশিষ্ট্য পাই, তা হলো: এই নির্বাচনে ভোটার কেন্দ্রে উপস্থিত না থাকলেও কমিশন ভোটের হার অবিশ্বাস্য রকম বাড়িয়ে দেয়নি। ভোটের আগের দিন বিরোধী দলের প্রার্থী এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখানো হয়নি। ভোটের দিন সকালে সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে কাউকে সশস্ত্র মহড়া দিতেও দেখা যায়নি। ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৩৪ শতাংশ, যা ৩০ ডিসেম্বরের অর্ধের কিছু বেশি। ৩০ ডিসেম্বর ভোট পড়েছিল ৬৫ দশমিক ৮ শতাংশ। এই নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে মাঠের ভোটচিত্রের খুব একটা ফারাক নেই।
এই প্রেক্ষাপটে নির্বচন কমিশন বগুড়া উপনির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ বলে দাবি করতে পারে। তাদের এ দাবি হয়তো পুরোপুরি অন্যায্য নয়। কিন্তু একটি প্রশ্নটি করতেই হয়, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের কৃতিত্ব কার? নির্বাচন কমিশনের, না সরকারের? প্রশাসন হস্তক্ষেপ করেনি বলেই নির্বাচনটি সুষ্ঠু হয়েছে। আর নির্বাচন কমিশন যদি এর কৃতিত্ব দাবি করে, তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্ন, তারা আগে নির্বাচনগুলো কেন সুষ্ঠু করল না? শুধু জাতীয় নির্বাচন না, সিটি করপোরেশন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন, যেখানেই হুদা কমিশন হাত দিয়েছে, সেখানে নির্বাচনের বারোটা বেজেছে। জনগণ ভোটকেন্দ্রে এক চিত্র দেখেছে। আর কমিশনের ফলাফলে অন্য চিত্র উঠে এসেছে। বগুড়া-৬–এর উপনির্বাচনে সেটি তারা করেনি বলে ধন্যবাদ জানাই। তাহলে এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে অন্তত একটি উপনির্বাচন সুষ্ঠু হলো।
সিইসি কে এম নূরুল হুদা একবার খেদের সঙ্গে বলেছিলেন, ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না এলে তাঁদের কিছু করার নেই। খুবই হক কথা বলেছেন। নির্বাচন কমিশন তো ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধরে বেঁধে কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারে না। কিন্তু ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না আসা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন যে প্রায় সব ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য ভোটের হার দেখিয়েছে, সেটি ভোটের নামে একধরনের জালিয়াতি। নির্বাচন কমিশনারদের বিবেকের কাছে (যদি আদৌ বিবেক বলে কিছু থেকে থাকে) একটি প্রশ্ন রাখতে চাই, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পড়েছে বলে যে প্রচার তাঁরা করেছেন, সেটি কি তাঁরা নিজেরা বিশ্বাস করেন?
বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে কোন দলের প্রার্থী জিতেছেন বা কোন দলের প্রার্থী হেরেছেন, তার চেয়েও বড় হলো নির্বাচনটি পরাজিত হয়নি। নির্বাচন কমিশনও কেন্দ্রে ভোটার থাকুক আর না-ই থাকুক, ভোট প্রদানের অবিশ্বাস্য হার ঘোষণা করেনি। বলতে হবে, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। কিন্তু এই শুভবুদ্ধি একটি উপনির্বাচনে সীমিত থাকবে, না পরবর্তী সব নির্বাচনে, সেই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র নির্বাচন কমিশনই দিতে পারে।
ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী বিএনপি প্রার্থী গোলাম মোহাম্মদ সিরাজের ধানের শীষ পেয়েছেন ৮৯ হাজার ৭৪২ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ মনোনীত টি জামান নিকেতা নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ৩২ হাজার ২৯৭ ভোট। অন্যদিকে, জাতীয় পার্টির প্রার্থী নুরুল ইসলাম ওমরের লাঙ্গল প্রতীকে পড়েছে ৭ হাজার ২২১ ভোট। বগুড়া সদর উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভার ২১টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত বগুড়া সদর আসন। এই আসনে ভোটার ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫৮ জন। এবারে এ আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ছাড়াও মোট ছয়জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৪১টি কেন্দ্রে ইভিএম মেশিনে ভোটাররা ভোট দিয়েছেন। ভোট পড়েছে ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। সব দলের প্রার্থীরা বলছেন, বগুড়ার এই আসনে এবার ভোটের চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে এবং সব প্রার্থীকে প্রচার-প্রচারণায় সমানভাবে সহযোগিতা করেছে।
গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে ও পরে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে। অনেকে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। অনেকে গ্রেপ্তার এবং হয়রানির শিকার হয়েছেন। ভোটের দিন সহিংসতা হয়েছে। কিন্তু উপনির্বাচনের আগে বা পরে এসবের কিছুই ঘটেনি। যে কারণে বিজয়ী ও পরাজিত সব প্রার্থী বলেছেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন কি দেশবাসীকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারবে যে ভবিষ্যতে প্রতিটি নির্বাচন বগুড়ার উপনির্বাচনের মতো সুষ্ঠু হবে। পরাজিত প্রার্থীও সেই নির্বাচন সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না।
সোহরাব হাসান: লেখক ও সাংবাদিক।