ফুলের আসর থেকে নাচ-গান বিতর্কে ভিসিরা

একটি বিশাল কক্ষে বসে আছেন একজন। তার চারদিকে ফুলের তোড়া। এ যেন জনপ্রিয় একটি গানকে মনে করিয়ে দেয়- তুমি হাজার ফুলের মাঝে একটি গোলাপ। একজন ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) যোগ দেবেন বলে কতো আয়োজন। রমজান মাসে ঢাকঢোল পিটিয়ে নেচে-গেয়ে স্বাগত জানানো হচ্ছে। ফুলের আসর থেকে নাচ-গান। স্বজনপ্রীতির সঙ্গে নিয়োগ বাণিজ্য। শেষ কর্মদিবসে নিয়োগ, ক্যাম্পাসে উপস্থিত না থাকাসহ নানা বিষয়ে সমালোচনা লেগেই আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে। প্রায়শই ভিসিদের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা করেন আন্দোলন। সমালোচনাকে সঙ্গে নিয়েই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

আবার অভিযুক্ত হওয়ার পরও ভিসিদের বিরুদ্ধে নেয়া হয় না শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। নানা বিতর্ক-সমালোচনা মাথায় নিয়ে মেয়াদ শেষ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভিসি অধ্যাপক শরফুদ্দিন আহমেদ। বিদায়ের ঠিক আগ মুহূর্তে অবৈধভাবে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। ‘শতাধিক’ শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগ তুলে আন্দোলন হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। অভিযোগ রয়েছে গত ২৩শে মার্চ আন্দোলন চলাকালে বিদায়ী ভিসি’র ব্যক্তিগত সহকারীসহ কয়েকজনকে মারধর করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়া হয়।

গত ২৮শে মার্চ অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এদিন বাদ্য বাজিয়ে নাচে-গানে বরণ করে নেন বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এনিয়ে নেটিজেনদের মাঝে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি যাবেন ভিসি আসবেন এটাই নিয়ম। ঢাকঢোল বাজিয়ে বরণ করার চোখে পড়ে খুব কম। আবার রমজান মাসে বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে নেচে-গেয়ে বরণ করায় সমালোচনার মাঝে পড়েছেন তিনি।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ভিসি অধ্যাপক সাদেকুল আরেফিন মেয়াদ শেষ করায় মিষ্টি বিতরণ করেছেন শিক্ষার্থীরা। জানা যায় শিক্ষার্থীরা ৭০০ মিষ্টি বিতরণ করেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, ভিসির কোনো কর্মকাণ্ডেই আমরা খুশি ছিলাম না। মেয়াদ শেষ করার আগে নিয়োগ নিয়েও বিতর্ক ওঠে তার বিরুদ্ধে। গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) ভিসি অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. ছাদেকুল আরেফিন মিলে সম্পন্ন করেন ভিন্ন এক নিয়োগ। ছাদেকুল আরেফিনের মেয়ে বশেমুরবিপ্রবির পুরকৌশল বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেন। এ নিয়োগের বিনিময়ে একিউএম মাহবুবের কন্যা ফারজানা মাহবুবকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পান বিশ্ববিদ্যালয়টির কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া। তিনি গত বছরের নভেম্বর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি’র রুটির দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু ভিসি যোগদানের পরই জন্ম দেন বিতর্কের। তাকে শুভেচ্ছা জানানো বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির ফুলের তোড়া একট্টা করে নিজ কক্ষে ছবি তোলেন। এনিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন রুচিবোধ নিয়ে। এই ছবি ব্যাপক ভাইরাল হয়। অনেকে তাকে কটাক্ষ করে ফুলের রাজা উপাধিও দেন।

আবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভিসি নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এর পূর্বে ভিসির দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক ড. শিরিন আখতার। তার বিরুদ্ধে অবৈধ নিয়োগের অভিযোগ এনে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করছিলেন শিক্ষকরা। তিনি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই নিয়োগ দিয়েছেন ১৯৫ জন কর্মচারীকে। তার মেয়াদের শেষ দিনে তিনি নিয়োগ দেন ৩২ জনকে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. এম আব্দুস সোবহান রীতিমতো সমালোচনার নতুন কীর্তি গড়ে তুলেছিলেন। তিনি শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালায় পরিবর্তন এনে মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ দেন। তিনি অবসর গ্রহণপূর্বক বিদায় নেন স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে। এমনকি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তার বাসভবন, প্রশাসনিক ভবন ও সিনেট ভবনে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। ২০২১ সালে তাকে পুলিশ পাহারায় ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়। এরপর আদালত অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া ১৩৮ জনের নিয়োগ স্থগিত করেন। সেইসঙ্গে স্থগিত করেন নিয়োগ নীতিমালা।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহকে নিয়েও ছিল বিস্তর সমালোচনা। তিনি নিয়মিত যেতেন না রংপুরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ সারতেন ঢাকায়। নিজের লোকবল নিয়োগের প্রতিবাদ করে আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষকরাও। তিনি রাত ৩টায় শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস করিয়েও জন্ম দিয়েছিলেন বিতর্কের। ৪৬টি অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। অভিযোগের সত্যতাও পায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এসবের বাইরে প্রধান অভিযোগ ছিল একটি প্রকল্পের মোট তিনটি স্থাপনার নকশা নিজের ইচ্ছামতো পরিবর্তন করে খরচ ১৩০ ভাগ বাড়িয়ে দেন। আগের পরামর্শক বাদ দিয়ে নিজের ভাগ্নেকে প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ দেন। একনেকের সুপারিশ ছাড়াই ৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার প্রকল্প বাড়িয়ে করেন ২১৩ কোটি টাকা।

আলোচিত এসব ঘটনার বাইরেও বিভিন্ন সময় সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন অনেক ভিসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক ভিসি ড. মো. আখতারুজ্জামানকে নিয়েও আছে নানা সমালোচনা। তার দেয়া একটি বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন সময়ে হয়েছে ট্রল। এ ছাড়াও ছাত্রলীগের ৩৪ জন নেতাকর্মীকে ‘চিরকুটের মাধ্যমে’ ভর্তি দেখিয়ে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হয়। এনিয়ে আন্দোলনও করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্যানেল নির্বাচনে ভোটের ফলাফল অনুযায়ী ভিসি প্যানেলে তিনজনের ক্রম ঠিক হওয়ার কথা থাকলেও তা মানেননি বলে অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে ছাত্রলীগকে দুই কোটি টাকা দেয়ার অভিযোগ উঠেছিল ভিসি অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন আন্দোলন হলেও পদ থেকে সরে যাননি তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ছাত্রী ও একটি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিকে প্রশ্ন করার জেরে করেছিলেন সাময়িক বহিষ্কার। এরপর আন্দোলন শুরু হয় ভিসির বিরুদ্ধে।

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এম অহিদুজ্জামান শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়োগ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত জানালেও মানেননি তিনি। ২০১৬ সালে ইউজিসি’র একটি তদন্ত দল তদন্তে গেলে তার পরিচিত লোকদের কর্মকর্তা ও বহিরাগত যুবকদের মহড়ায় ভীত হয়ে তদন্ত দল ঢাকায় ফিরে আসে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান শিক্ষার্থীদের মেস ভাড়ার সংকট নিরসন ও যুবলীগের সদস্য হওয়ার ইচ্ছাপোষণ করে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হল প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা হয়। এরপর ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদের পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশনে বসেন শিক্ষার্থীরা।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে বিতর্ক থামছেই না। নানা সময়েই তাদের স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতিসহ নানা বিষয় উঠে আসছে গণমাধ্যমে। কেন এত বিতর্ক এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি’র সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী বলেন, মূল্যবোধের যখন অবক্ষয় হয় তখন সব জায়গাতেই হয়। শিক্ষক বা বিশ্ববিদ্যালয় তো আইসোলেটেড আইল্যান্ড না। আমাদের মূল্যবোধের বিষদ ধস নেমেছে। কিন্তু এটা বেশি চোখে লাগে কারণ শিক্ষকরাই তো আদর্শের বাতিঘর হবেন। শিক্ষক নতুন আশার আলো জাগাবেন। শিক্ষকদের যদি এই অবস্থা হয় তবে সমাজে আশার আলো আসবে কোথা থেকে? এটা নিন্দনীয়, দণ্ডনীয় শাস্তি হওয়া উচিত। আর শিক্ষক নিয়োগের সময় তার স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায়নিষ্ঠা ক্যারিয়ারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা জরুরি। এগুলো যদি না থাকে তাহলে তো আর শিক্ষকতার চাকরি হওয়া উচিত নয়।

তিনি আরও বলেন, সব পচে যাক কিন্তু আদর্শের জায়গাটা ঠিক থাকুক।  আারেকটা কারণ হচ্ছে বর্তমানে সারা দেশে ৫৬টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এখন ৫৬ জন করে যোগ্য ভিসি, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, ট্রেজারার, প্রক্টর নেই। তাদের কোনো বায়োডাটা নেই। যে যখন যেখান থেকে তদবির করতে পারছে সেখান থেকেই নিয়োগ নিয়ে নিচ্ছে। আবার অনেক ভিসি অযোগ্য হয়েও নিয়োগ পাচ্ছেন। আবার অনেকে যোগ্য হয়েও ওই জায়গায় যেতে পারছেন না।

manabzamin