প্রথম ১০ দিনেই রিজার্ভ কমল ১.৬৯ বিলিয়ন ডলার!

রিজার্ভের পতন কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। গত দুই বছরের ধারাবাহিকতায় নতুন বছরের শুরুতেও কমতে শুরু করেছে রিজার্ভ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণের কিস্তি যোগ হওয়ায় গত মাসে রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছিল। তবে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধের পর ফের কমেছে রিজার্ভ।

২০২৪ সালের প্রথম ১০ দিনে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে বিপিএম-৬ অনুযায়ী ২০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের শেষ দিন (৩১ ডিসেম্বর) যা ছিল ২১ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ জানুয়ারির প্রথম ১০ দিনে রিজার্ভ কমেছে ১ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার বা সাত দশমিক ৭৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গত ১৩ ডিসেম্বর বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে বাংলাদেশের গ্রস ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (জিআইআর) ছিল ১৯ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। এরপর ১৫ ডিসেম্বর আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তিতে ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার এবং এডিবির দেয়া ঋণের ৪০ কোটি ডলার বাংলাদেশের রিজার্ভে যোগ হয়। এছাড়া আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণের জন্য বিভিন্ন ব্যাংক থেকে গত মাসে ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ৩১ ডিসেম্বর বিপিএম-৬ অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ২১ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।

যদিও চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নভেম্বর-ডিসেম্বর সময়ের আমদানি দায় বাবদ আকুতে পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ১২৮ কোটি ডলার (১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার)। এছাড়া খোলাবাজারে ডলার বিক্রি অব্যাহত রয়েছে নতুন বছরেও। এতে ১০ জানুয়ারি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। যদিও বর্তমানে নিট রিজার্ভ নেমে গেছে ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে।

গত মাসে প্রকাশিত আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জুনে দেশে নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ তথা এনআইআর ছিল ১৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। অক্টোবরে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ তিন মাসে নিট রিজার্ভ কমে ৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার। তবে নভেম্বরের শুরুতেই আকুর দায় পরিশোধ করা হয় ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। এতে ওই মাসে নিট রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়।

সূত্রমতে, ডিসেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার রাখার সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল আইএমএফ। তবে সে লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। আইএমএফ ও এডিবির ঋণের ১ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার যোগ হওয়া এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কেনায় ৩১ ডিসেম্বর নিট রিজার্ভ দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। তবে আকুর দায় ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের পর বর্তমানে তা আবার ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে।

এর আগে গত বছর মার্চ, জুন ও সেপ্টেম্বরেও আইএমএফের বেঁধে দেয়া নিট রিজার্ভ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। এজন্য আইএমএফের এ শর্ত প্রথম কিস্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন রিভিউ তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য বলেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তা বিবেচনায় নিয়ে ঋণের শর্ত পূরণে ছাড় দেয় আইএমএফ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি দুই মাস পরপর আকুর দায় শোধের পর রিজার্ভে বড় ধাক্কা লাগে। এর আগে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের আকুর দায় বাবদ ১২১ কোটি ডলার পরিশোধ করে বাংলাদেশ। তার আগে গত জুলাই-আগস্ট সময়ের আকুর দায় বাবদ সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ১৩১ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালের ৩০ জুন বিপিএম-৬ অনুযায়ী দেশে রিজার্ভ ছিল ৩৯ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। তবে আগস্টে তা কিছুটা বেড়ে হয়েছিল ৪০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। এরপর ২০২২ সালের ৩০ জুন তা কমে দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার ও ২০২৩ সালের ৩০ জুনে ২৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। আর গত ৩১ ডিসেম্বর রিজার্ভ দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আড়াই বছরে রিজার্ভ কমেছে ১৭ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার বা ৪৪ দশমিক ২৫ শতাংশ।

রিজার্ভের এ ধরনের হ্রাস পাওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমানে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ভালো অবস্থানে নেই। গম, ডাল, তেল ইত্যাদি আমদানি করতেই হবে। এতে করে রিজার্ভের আরও রক্তক্ষরণ হবে। তবে রিজার্ভ ধরে রাখতে সরকারের নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক সুদহার ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ডলারে আয় বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উৎস খুঁজে বের করতে হবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ৩০০ কোটি ডলার বা ৩ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ২০০১-০২ অর্থবছর পর্যন্ত রিজার্ভ আর ২ বিলিয়ন ডলারের (২০০ কোটি ডলার) স্তর ছুঁতে পারেনি। এরপর ধীরে ধীরে রিজার্ভ বাড়তে থাকে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বৈশ্বিক মন্দা হলে রিজার্ভ সাত বিলিয়ন থেকে কমে পাঁচ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।

২০০৯ সালের পর রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। কভিডের কারণে আমদানি কমে যাওয়ায় এবং প্রবাসী আয়ে বড় উত্থান হলে ২০২১ সালের আগস্টে মোট রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। তবে ওই সময় বিপিএম-৬ অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। এরপর কোনো কোনো মাসে সামান্য বাড়লেও, রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।

শেয়ারবিজ