পৌঁছাতে কেন মরিয়া বাংলাদেশীরা


অনিয়মিত পথে গত বছর অন্তত আট হাজার ৬৬৭ জন বাংলাদেশী ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ঢুকেছেন৷

ইউরোপের বহিঃসীমান্তরক্ষী সংস্থা ফ্রনটেক্স-এর হিসাবে ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে অবৈধভাবে ইটালি প্রবেশের তালিকায় বাংলাদেশীরা রয়েছেন দ্বিতীয় অবস্থানে৷

গত বছর লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইটালি আসেন বাংলাদেশের সবুজ৷ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমি লিবিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই৷ পরিবারের আট জনের মধ্যে আমিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি৷’

২০২০ সালে প্রায় চার লাখ টাকা খরচে লিবিয়া পৌঁছান ২৫ বছর বয়সি এই যুবক৷ সেই সময় অবশ্য তার ইটালি যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না৷ লিবিয়ার বেন গাজিতে শুরুতে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তিনি৷ কিন্তু সেখানে নিয়মিত বেতন পেতেন না৷ বকেয়া চাইতে গেলে উল্টো মারধরের শিকার হতেন বলে জানান তিনি৷ একপর্যায়ে সবুজ উন্নত জীবনের আশায় লিবিয়া থেকে ইটালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷

‘একটি নৌকায় করে ২৪ ঘণ্টা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আমরা ২০২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি লাম্পেদুসা দ্বীপের কাছে পৌঁছাই৷ ওই নৌকায় মোট ৯৩ জন ছিলেন৷ এর মধ্যে ৪০ জনের বেশি ছিলেন আমাদের দেশি,’ বলেন তিনি৷

ইটালি পৌঁছানোর পর থেকে রোমে একটি অভিবাসন কেন্দ্রে রয়েছেন সবুজ৷ তার স্বপ্ন ইউরোপীয় দেশটিতে একটি ভালো চাকরি করা, যদিও সেই স্বপ্ন এখনো অধরা৷

সবুজ বলেন, ‘আমাকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইটালি আসতে দুই হাজার ইউরো খরচ করতে হয়েছে৷ কিন্তু এখনো আমি বেকার৷ এখানে কাউকে চিনি না আমি৷ কেউ এখানে আমাকে চাকরি দিচ্ছে না৷ দেশে এখনো আমার মা মানুষের ঘরে কাজ করছে৷ জানি না সামনে কী আছে৷’

ট্রানজিট লিবিয়া
সমুদ্রপথে ইটালিতে আসা অভিবাসীদের বড় একটি অংশই পাড়ি জমান উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া থেকে৷ ইউএনএইচসিআর এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি মাসে সমুদ্রপথে ইটালিতে পৌঁছেছেন দুই হাজার ৯৯৫ জন৷ এর মধ্যে ২০৯১ জনই লিবিয়া থেকে এসেছেন৷ এদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশী৷

লিবিয়ায় অবস্থানরত অভিবাসীদের নিয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা আইওএম এর সবশেষ প্রকাশিত ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে ২০ হাজার ২৫৪ জন বাংলাদেশী ছিলেন, যা মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে আগত অভিবাসীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ৷

ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই অভিবাসীদের ২৪ শতাংশ দেশটিতে এসেছেন তুরস্ক হয়ে৷ ১৯ শতাংশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশর হয়ে এবং ১৬ শতাংশ এসেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে তুরস্ক হয়ে৷ বাকি ৪১ শতাংশ অন্য রুট যেমন, ভারত, কাতার, কুয়েত, জর্ডান, টিউনিশিয়া বা অন্য কোন দেশ ঘুরে লিবিয়া আসেন৷ এজন্য তারা বাংলাদেশী মুদ্রায় জনপ্রতি প্রায় আড়াই লাখ টাকা থেকে (২,৬৮২ ডলার) থেকে সোয়া তিন লাখ টাকার বেশি (৩৮৬৩ ডলার) ব্যয় করেন৷ পরে সেখান থেকে তারা ইউরোপে বিশেষ করে ইটালিতে যাওয়ার চেষ্টা করেন৷

সবচেয়ে বেশি অভিবাসী পাঠানো ও গ্রহণের দেশ ভারত-
অভিবাসীদের সংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে ভারত৷ দেশটির এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন৷

গন্তব্য ইউরোপ
গত এক দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচকগুলো উর্ধ্বমুখী৷ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রতিবছর৷ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ উন্নত জীবনের স্বপ্নে ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ পাড়ি জমাচ্ছেন৷

ইউরোপের বহিঃসীমান্তরক্ষী বাহিনী ফ্রনটেক্সের হিসাবে গত বছর আট হাজার ৬৬৭ জন অবৈধ উপায়ে ইইউ দেশগুলোতে প্রবেশ করেছেন৷ এর মধ্যে সাত হাজার ৫৭৪ জনই এসেছে মধ্য ভূমধ্যসাগর হয়ে৷ ৬০৪ জন প্রবেশ করেন পূর্ব ভূমধ্যসাগর দিয়ে, আর ৪৩৭ জন ঢুকেছেন পশ্চিম বলকান দিয়ে৷ ফ্রনটেক্সের এই তালিকায় লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইটালিতে আসাদের মধ্যে বাংলাদেশীদের অবস্থান দ্বিতীয়৷ এই পথ পাড়ি দিয়ে ইটালির লাম্পেদুসায় পৌঁছাতে গিয়েই গত মাসে সাত বাংলাদেশী ঠান্ডায় মারা যান৷

রোমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান জানান, দেড় লাখের মতো বাংলাদেশী অভিবাসী বর্তমানে ইটালিতে বসবাস করছেন৷ এত বাংলাদেশী নেই ইইউভুক্ত আর কোনো দেশে৷ তিনি ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘এমন একটা ধারণা মানুষের মধ্যে আছে যে ইটালি বিদেশীদের প্রতি খুবই আন্তরিক৷ তারা মনে করে কোনোভাবে দেশটিতে আসতে পারলে এক পর্যায়ে বৈধতা পাওয়া যাবে৷’

বৈধ অভিবাসনের সীমিত সুযোগ
আট বছর বন্ধ থাকার পর ইটালি বাংলাদেশীদের জন্য সিজনাল ও নন সিজনাল ভিসা আবেদনের সুযোগ করে দিয়েছে৷ এই স্কিমের অধীনে বাংলাদেশসহ ৩০টি দেশ থেকে ৬৯ হাজার ৭০০ অভিবাসীকর্মী আনার অনুমতি দিয়েছে দেশটির শ্রম ও সামাজিক পরিকল্পনা বিষয়ক মন্ত্রণালয়৷

এ বিষয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান বলেন, ‘বাংলাদেশের অভিবাসীদের ইটালিতে বৈধপথে আসার চেষ্টা করা উচিত৷ কেননা অবৈধদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সাক্ষরিত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসেডিউর্স (এসওপি) এর আওতায় বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে৷’

তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইটালিতে বাংলাদেশীদের জন্য বৈধপথে আসার সুযোগ এখনো বেশি সীমিত৷

ইটালির ভেনিসে অবস্থানরত বাংলাদেশী সাংবাদিক পলাশ রহমান বলেন, ‘সাম্প্রতিক সার্কুলারের অধীনে মাত্র সাড়ে তিন হাজার বাংলাদেশী আসার সুযোগ পাবে৷ ইউরোপে আসতে আগ্রহীদের তুলনায় এই সংখ্যা খুবই নগণ্য৷’

তিনি মনে করেন, অনিয়মিতি উপায়ে ইউরোপে আসার প্রবণতা বন্ধ করতে হলে বৈধ উপায়ে আসার সুযোগ আরো বৃদ্ধি করতে হবে৷