পাঠ্য বই বিতর্ক

Farhad Mazhar    28 Janury 2023  From his Facebook entry
১. পাঠ্য বই বিতর্ক
২৭ জানুয়ারী ২০২৩ তারিখে পেশাজীবী অধিকার পরিষদের সভা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সময় স্বল্পতার মধ্যে ২০২৩ সালের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আলোচনা সভায় কিছু কথা বলার চেষ্টা করেছি। বিষয়টি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। আশা করব বিষয়টির গুরুত্ব আমরা সকলে বুঝতে পারব।
আমাদের রাজনৈতিক পশ্চাতপদতার প্রধান লক্ষণ হচ্ছে শিক্ষার মর্মের প্রতি অবিশ্বাস্য অবহেলা। ফ্যাসিস্ট শক্তি পাঠ্যবই নিয়ে যে কাজটা করেছে সেটা ক্রিমিনাল কাজ। এই অপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধের ব্যক্তির নয়, বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট শক্তির।  এর সহযোগী হচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং জাফর ইকবালসহ পাঠ্যবই পয়দার সঙ্গে যুক্ত সকলের। তাই বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক সত্তাকে গোড়াতেই হত্যার পরিকল্পনা বলে সিরিয়াস অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে এই ‘গেরুয়া’ পাঠপুস্তক মোদি-আমিত শাহের হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে শিশু বয়স থেকে স্বেচ্ছা সেবক সঙ্ঘের সদস্য হিশাবে গড়ে তোলার বুদ্ধি।  মোদি-অমিত শাহ ভারতে ক্ষ্মতায় আসার পর পাঠপুসক পরিবর্তনে হাত দিয়েছিল। তারা ভারতের ইতিহাস হিন্দুর ইতিহাস হিশাবে তাদের শিশূদের পড়চ্ছে কারন উপমহাদেশ থেকে ইসলাম নির্মূল ও মুসলমান বিতাড়ন তাদের রাজনীতি। সেই রাজনীতির চেতনাগত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক শর্ত তৈরি করাআর গুরুত্ব বিজেপি বুঝেছে। এখন সেই মডেল বাংলাদেশো প্রয়োগ প্রয়োগ গণ পধিকার পরিষদের পক্ষে পেশাজীবী অধিকার পরিষদ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে সেই জন্য তাদের অভিনন্দন জানাই।
ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তির এই পরিকল্পনাকে রুখে দেওয়া সম্ভব হবে কিনা জানি না।সংশয়ের কারন শুধু ক্ষমতাসীনরা নয়, এমনকি জাফর ইকবালরাও নয় — তাদের মোকাবিলা করা সহজ। কিন্তু শিক্ষাকে এখনও রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে গঠন ও রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে নিজেদের বিকশিত করবার প্রক্রিয়া হিশাবে আমরা বুঝি না। আমাদের দুর্দশার কারন অন্যদের মধ্যে না খুঁজে আগে নিজদের অজ্ঞতা, মেরুদণ্ডহীনতা এবং অসুস্থ চেতনার জায়গায় খুঁজতে হবে। নিজেদের হালত , নিজেদের বিমারি ইত্যাদি আগে বোঝা দরকার।
রাজনীতি বলতে আমরা এখনও চোর, বদমাশ, গুন্ডা, দুর্বৃত্ত, ডাকাত, লুটেরা ও মাফিয়া গোষ্ঠির ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা বুঝি। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ করা ছাড়া শিক্ষা নিয়ে দূরদর্শী ও সুদূর প্রসারী কোন চিন্তা করতে আমরা জানি না। শিখি নি। শিক্ষার সঙ্গে একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সত্তা নির্মাণের প্রশ্ন জড়িত। সেই চিন্তা ও দূরদর্শিতা গড়ে তোলা দুঃসাধ্য কাজ। কিন্তু করতে তো হবে। উপায় নাই। এই শিক্ষাই আগে নিতে হবে, যেন এখনকার জরুরি কর্তব্যবোধের তাগিদ তীব্র তৈয়ার হয়।
রাজনৈতিক সত্তা চিরারত বা শ্বাশ্বত কিছু না। আমরা একসময় উপমহাদেশে সকলের সঙ্গে এক সঙ্গেই থাকতে চেয়েছি। কলকাতার বাবুবাঙালির জন্য সেটা হয় নি। এরপর পাকিস্তানের সঙ্গেও থাকতে চাইবার ক্ষেত্রে আমাদের আন্তরিকতার অভাব ছিল না। আমরা সেই দোষে হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণের শিকার হয়েছি। এখান হিন্দুত্ববাদী ভারত তো বটেই , এমনকি মায়ানমারও আমামদের দুষমন। এখন বাংলাদেশ অস্তিতের সংকটে নিমজ্জিত। আমাদের কাজ হচ্ছে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখা। হিন্দুত্ববাদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে  ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি  ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক চেতনা অবশিষ্ট রয়েছে তাকে ধ্বংস করা। আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে নিজেদের রাজনৈতিক সত্তার উপলব্ধি — তার যথাযথ বয়ান হাজির করা এবং রক্ষা করা। বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখতে হল্লে শিক্ষা ব্যবস্তা রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু — এই হুঁশ আমামদের হোক। ।
সেই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের নির্বাচন-সর্বস্ব দাবির বাইরে রাজনৈতিক সত্তার সুরক্ষা এবং রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে টিকে থাকতে হলে আমাদের বুঝতে হবে আমরা কারা?  কেন আমরা পাকিস্তানবাদ চাই নি, তেমনি কেও এখন হিন্দুত্ববাদও চাই না। আমামদের রাজনোইতিক সত্তাকে  মুসলমান বনাম হিন্দুর তর্কে পর্যবসিত করা যাবে না।
শিক্ষা রাজনৈতিক সত্তা নির্মাণ করে– সেই দিক থেকে শিক্ষা জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং বিশেষ ভাবে গণপ্রতিরক্ষার সঙ্গে যুক্ত। অথচ জাতীয় প্রতিরক্ষাকে আমাদের মতো বেয়াকুব জাতি এখনও স্রেফ সামরিক বাহিনী পোষা বোঝে।  — আসলে আমাদের কি প্রতিরক্ষা করতে হবে সে ব্যাপারে আমাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র হুঁশ নাই।  সেনাবাহিনী আমাদের সামষ্টিক রাজনৈতিক  সত্তাকে কখনও রক্ষা করতে পারে না, যদি তারা উপযুক্ত শিক্ষা না পায়। কারণ সৈনিকদেরও শিক্ষার প্রয়োজন আছে। আর সেটা তারা প্রাথিমিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেই লাভ করে। জাতীয় প্রতিরক্ষাকে গণপ্রতিরক্ষার আলোকে গড়ে তোলা জরুরি।  শিক্ষা রাজনৈতিক সত্তার উপলব্ধি  নির্মানএবং তা রক্ষার প্রণোদনা।
অথচ আমরাই একমাত্র যারপরনাই স্টুপিড জনগোষ্ঠি যারা রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের পরেও নিজেদের রাজনৈতিক সত্তা নির্মাণের জন্য চিন্তাভাবনা করি না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে আমরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটা গৃহযুদ্ধ জারি রেখেছি। পাঠপুস্তক তার প্রমাণ। পাঠ্যপুস্তক সেই যুদ্ধেরই অস্ত্র হিশাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নিজেদের রাজনৈতিক সত্তার অন্বেষণ, বিচার বা পর্যালোচনার কোন তাগিদ আমরা বোধ করিনা। রাজনৈতিক সত্তা নির্মাণ ও স্পষ্ট বয়ান হাজির কবার কোন দাবি, কর্মসূচি বা পরিকল্পনা আমাদের নাই নাই।
কেন নাই? কারন শিক্ষাকে আমরা রাজনৈতিক বিষয় মনে করিনা , ফলে তা দলীয় গুন্ডাপাণ্ডাদের হাতিয়ার হয়ে গিয়েছে।
রাজনীতি মানে শুধুই নির্বাচন, শিক্ষা কোন ইস্যুই না, রাজনৈতিক দল হিশাবে লুটেরা ও দুবৃত্তদের স্বার্থে তাদের দাস বা চাকর হিশাবে ভূমিকা রাখাকেই আমরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড গণ্য করি। এই এক অবিশ্বাস্য পরিস্থিতি। কাকে দোষ দেব? আমরা ‘রাষ্ট্রকাঠামোর মেরামত চাই’ – কিন্তু সেই কাঠামোর মর্ম বা ভেতরের সারপদার্থ আছে কি নাই বা কিজিনস সে ব্যাপারে কোন খবরই নাই।
পেশাজীবি অধিকার পরিষদের সভায় শিক্ষার সারকথাটাই বোঝাতে চেয়েছি  সেটা হোল রাজনৈতিকতার দিক থেকে সার্বজনীন শিক্ষা বলে কোন শিক্ষা নাই। শিক্ষা যে কোন জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক সত্তা নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। প্রাইমারি স্তরের শিক্ষা রাজনৈতিক সত্তা নির্মাণের গোড়ার কাজটা করে। ফলে পাঠ্যবই বিতর্ক স্রেফ পাঠ্য বইয়ের তর্ক নয়। বাংলাদেশের রাজনীতির গোড়ার তর্ক।
শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে আমাদের চিন্তাচেতনা, বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা, জ্ঞান বা প্রজ্ঞার স্ফুরণ ও বিকাশ ঘটে এবং কেন বিশ্ব রাষ্ট্র সভায় আমাদের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশাবে টিকে থাকা জরুরি, সেই বোধ প্রখর হয়।
কেন আমরা একাত্তরে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়লাম এবং সাতচল্লিশে কেন হিন্দুত্ববাদী ভারতের সঙ্গে থাকি নি? – সেই ইতিহাস ও রাজনৈতিক চেতনা শিশু বয়স থেকে আমাদের সন্তানদের পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের সামষ্টিক রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক অর্জন স্পষ্ট করতে হবে। যদি আমরা বাচ্চাদের মোদি-অমিতশাহের হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ শেখানোকে শিক্ষা বলি, তাহলে ভারতের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়াই তো আমাদের নিয়তি। ক্ষ্মতাসীনরা তাই চায়?
বিশ্বরাষ্ট্রসভায় কেন আমাদের আলাদা রাষ্ট্র দরকার কিম্বা বিশ্বে আমাদের নতুন কি দেবার আছে সেই গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো শিশুকাল থেকে বাচ্চা ও কিশোর-কিশোরিদের বোঝানো আমাদের কাজ। আমাদের রাজনৈতিক সত্তার স্বরূপ কেমন সেটাই রাজনীতি বা রাজনৈতিকতার গোড়ার আলোচনা। সেই বোধ তৈরি প্রাথমিক শিক্ষার কাজ।
আশা করি তরুণ রাজনৈতিক নেতারা ডাকাত-লুটেরা-মাফিয়া গোষ্ঠির ক্ষমতার প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপররতার ক্ষেত্রগুলো চিনবেন এবং সেখানকার কাজকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে সক্ষম হবেন।
পাঠ্যবই সংক্রান্ত তর্ক বিতর্ক নিয়ে যে কথাগুলো বলার প্রয়োজন মনে করি সেটা পরের কিস্তিগুলোতে বলার চেষ্টা করব।