আজলান আলী এখনো স্মরণ করেন যে ২০২০ সালের দিকে সকালে কলেজে যাওয়ার আগে তিনি বাজারে গিয়ে পুরি খেতেন, সঙ্গে ছোলা আর মৌরি দেওয়া আলু। তাঁর খাওয়া শেষ হতো এক গ্লাস মিষ্টি মাখন-দুধ খেয়ে। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের কাছে রাওয়ালপিন্ডির একটি বাজারে এসব খাওয়ার আগে তাঁকে পাক্কা একটি ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো।
কিন্তু গত মাসের শেষের দিকে বাবার সঙ্গে ওই বাজারে গিয়ে তাঁর ‘হৃদয় ভেঙে যায়’, যখন তিনি দেখেন মাত্র গুটিকয় মানুষ সেখানে আছেন। কিন্তু নেই অসম্ভব-মিষ্টি, ঘিয়ে-জড়ানো মিঠাই—যার জন্য বাজারটি বিখ্যাত ছিল। এমনকি তাঁর সকালের নাশতার জন্য আমের আচারও আনতে হয়েছে অন্য জায়গা থেকে।
‘এখানেই আমি বড় হয়েছি,’ বলছিলেন তুরস্কের সাবানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী। ‘এটি এখন খালি। মৃত। আমি সত্যিই বিধ্বস্ত।’
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তান এখন জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকটের মধ্যে রয়েছে। ঘি, রান্নার তেল, দুধ, চিনি এবং ডিম–মিঠাই বানাতে ব্যবহার করতে হয়, এমন সবকিছুর দাম দ্বিগুণ হয়েছে গত তিন বছরে। সঙ্গে বেড়েছে গ্যাস আর বিদ্যুতের দাম।
গত জানুয়ারিতে পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি গত ৪৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি—২৭ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছায়। বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের পতন এবং রুপির অবমূল্যায়নের পটভূমিতে মানুষের চাহিদাও কমেছে।
মিসরের গল্পও অনেকটা একই রকম। সেখানে ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ২১ দশমিক ৯ শতাংশ। দেশটির অনেক তরুণ ‘তাঁদের স্বপ্নকে আটকে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ, বিয়ে করা কিংবা বাড়ি বা গাড়ি কেনা এখন তাঁদের সাধ্যের বাইরে,’ বলেছেন শাহিরা আমিন, যিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের স্কোক্রফট মিডল ইস্ট সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভের কায়রোভিত্তিক অনিবাসী ফেলো।
পাকিস্তানের মতো মিসরও চীন থেকে ঋণ এবং বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল। দুটি দেশই এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের অর্থিক পুনরুদ্ধারের ঋণ পাওয়ার জন্য বেদনাদায়ক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে অতিমাত্রায় মিল থাকলেও পাকিস্তান এবং মিসর—এত বড় দুটি দেশ যে তাদের ব্যর্থ হওয়া চলে না। প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা গত এপ্রিলে তার আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়েছিল।
মিসর আর পাকিস্তানের মিলিত জনসংখ্যা ৩৩ কোটির বেশি। রয়েছে বিশাল সামরিক বাহিনী। তাদের যেসব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মিত্র রয়েছে—তেলসমৃদ্ধ আরব উপসাগরীয় রাষ্ট্র, আইএমএফ, জি সেভেন এবং চীন —তারাই চাইবে না যে মিসর ও পাকিস্তান ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হোক।\মোট দেশজ উৎপাদনের অনুপাতে দুই দেশের ঋণ—পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ এবং মিসরের ৮৬ শতাংশ—শ্রীলঙ্কার তুলনায় ভালোভাবে সামলানো যেতে পারে। শ্রীলঙ্কার ঋণের হার জিডিপির ১২২ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু উভয় দেশই এখন ‘লেনদেনের ভারসাম্যের সক্ষমতা ফেরাতে লড়াই করছে, ফলাফল হিসেবে দুই দেশেই গুরুতর আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে’, বলছিলেন নাজাম আলী, যিনি একজন অর্থনীতিবিদ এবং করাচিভিত্তিক আর্থিক পরিষেবা সংস্থা নেক্সট ক্যাপিটালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
কোনো দেশই অবশ্য ‘অদূর ভবিষ্যতে তাদের বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হবে না’, যোগ করেন নাজাম আলী, তবে ‘মাঝারি থেকে দীর্ঘ মেয়াদে এ–জাতীয় ঝুঁকি এড়ানোর জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি তাদের বিচক্ষণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।’
বেহিসেবি ঋণ গ্রহণ
মিসর ও পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন সেনা-সমর্থিত অভিজাতেরা। ভোট কিংবা উগ্রপন্থা ছড়ানোর মাধ্যমে যে রাজনৈতিক ইসলামের বিস্তার ঘটে, তার প্রতি বাধা হিসেবে এই দুই দেশকে বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। সে কারণে তাদের নিজ নিজ এলাকায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য মিসর ও পাকিস্তানকে অপরিহার্য বলে মনে করা হয়।
মিসরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি দেশটির সাবেক সেনাপ্রধান। ২০১৩ সালে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুড প্রশাসনকে উৎখাত করে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। ২০১১ সালের বিপ্লবে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক হোসনি মুবারকের পতনের পরে যে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে জিতে ক্ষমতায় এসেছিল ব্রাদারহুড। কিন্তু এক বছরের বেশি তারা ক্ষমতায় টিকতে পারেনি।
পাকিস্তানও একইভাবে কয়েক দশক ধরে সামরিক শাসনের অধীনে কাটিয়েছে। কিন্তু যখন সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতায় ছিল না, তখনো তারা নিশ্চিত করেছে যে তারাই থাকবে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। ফলে পাকিস্তানের কোনো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীই কখনো তাঁর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ একেবারে সামনের সারির অংশীদার উভয় দেশের সামরিক বাহিনী সেই আল-কায়েদা থেকে শুরু করে ইসলামিক স্টেট এবং তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান পর্যন্ত।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ জবাবদিহির অভাব, সঙ্গে ভূরাজনৈতিক অগ্রাধিকার, দীর্ঘকাল ধরে মিসর ও পাকিস্তানকে চীন, আইএমএফ, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে ব্যাপকভাবে ঋণ গ্রহণের সুযোগ দিয়েছে। আর এই অর্থ খরচ করা হয়েছে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বড় প্রতিরক্ষা বাজেট এবং বিতর্কিত উন্নয়ন কর্মসূচির পেছনে, যার উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা বাড়ানো।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে চীনের কাছ থেকে পাকিস্তান বড় অঙ্কের অর্থ ধার করেছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার খরচ করা হয়েছে দেশটির বিদ্যুতের ঘাটতি দূর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ার পেছনে।
২০১৯ সালে, ইসলামাবাদ আইএমএফের ঋণ গ্রহণের বিষয়ে সম্মত হয়েছিল লেনদেন ভারসাম্যে সংকটের কারণে। এই সংকট দেখা দেয় দেশটির সংকীর্ণ রপ্তানি ভিত্তি এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের অভাবের কারণে। ১৯৮০’র দশকের পর এটি ছিল পাকিস্তানের জন্য আইএমএফের ১৩ তম ঋণ কর্মসূচি।
মিসরে আল-সিসির প্রশাসন একইভাবে তথাকথিত মেগা প্রকল্পগুলোতে ঋণের অর্থ ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে পাঁচ হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে একটি নতুন প্রশাসনিক রাজধানী নির্মাণ। কায়রোর কাছে এটি নির্মাণ করা হচ্ছে, আর কাজগুলো করছে বিভিন্ন চীনা কোম্পানি।
‘যদি কিছু হয়ে থাকে, তাহলো এসব ঋণ হিতে বিপরীত ফল এনেছে। এর ফলে সুবিধাবঞ্চিত মিসরীয়দের অসহায়ত্ব আরও বেড়েছে, আর্থসামাজিক সমস্যাগুলো আরও জটিল হয়েছে,’ বলছেন কায়রোভিত্তিক বিশ্লেষক শাহিরা আমিন।
‘এর প্রধান কারণ, অভিজাত শাসকেরা এই অর্থ নয়ছয় করেছেন। এ ঋণ এমন সব মেগা প্রকল্পের পেছনে খরচ করা হয়েছে, যেগুলো মিসরীয়দের জন্য আদৌ কোনো সুবিধা বয়ে আনবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।’
দুর্নীতি, অতিরিক্ত ব্যয় এবং কাঠামোগত সংস্কারের অভাবের কারণে শেষ পর্যন্ত দুই দেশেরই আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। পরিস্থিতি আরও সঙিন হয় রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর খাদ্য ও জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে মিসর আর পাকিস্তানের পক্ষে জ্বালানি এবং খাদ্য আমদানির জন্য অর্থ জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়েছে, সঙ্গে যোগ হয়েছে বিপুল আন্তর্জাতিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ।
পাকিস্তান ও মিসর—উভয়েই তাদের জাতীয় বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অর্থ ঋণ পরিশোধে ব্যয় করে। এই হার দেশ দুটিতে দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী জনসংখ্যার হারের সমান।
অতিরিক্ত কাটছাঁট
উভয় দেশেই খাদ্য ও জ্বালানির ঘাটতি এখন একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে লাখ লাখ মানুষ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
পাকিস্তানি রুপি এবং মিসরীয় পাউন্ড গত এক বছরে ব্যাপকভাবে মূল্য হারিয়েছে। ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের আইএমএফ ঋণ পেতে মিসরের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে। ফলে পাউন্ডের পতন ঘটে প্রায় ৪৫ শতাংশ। আর বিনিময় হারের সীমা তুলে নেওয়ার পর এক দিনেই রুপির দাম কমে ১০ শতাংশের বেশি।
করাচিভিত্তিক অর্থনীতিবিদ নাজাম আলী বলেছেন, দুই দেশই তাদের মুদ্রানীতিতে ‘বিবেচনাপূর্ণ কঠোরতা’ গ্রহণ করেছে।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত সেপ্টেম্বর থেকে তার নীতি সুদহার ১০ শতাংশ বাড়িয়েছে। অন্যদিক মিসর অক্টোবর থেকে সুদের হার বাড়িয়েছে ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যে সুদের হার ভবিষ্যতে আরও বাড়ানো হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশ দুটির আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা এটা বিশ্বাস করে না যে দুই দেশের সরকার শেষ পর্যন্ত কাঠামোগত সংস্কারের প্রতিশ্রুতি রাখবে।
উদাহরণ স্বরূপ, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত বলেছে যে মিসর ও পাকিস্তানকে আরও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করবে তাদের বড় রাষ্ট্রমালিকানাধীন সংস্থাগুলোর মধ্যে একটিতে কৌশলগত অংশীদারত্ব পাওয়ার ওপর।
অর্থনীতিবিদ নাজাম আলী অবশ্য মনে করেন, উভয় সরকারই শেষ পর্যন্ত ‘বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে’, যদি তারা মিতব্যয়ী হয়, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এড়ায় এবং আইএমএফ ও বন্ধুদেশগুলোর অব্যাহত সমর্থন পায়।
কিন্তু তিনি এ–ও সতর্ক করে দেন, ‘এসব পদক্ষেপ খুব বেশি দিন চালানো যায় না। কারণ, এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয় এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। সঙ্গে মূল্যস্ফীতি বাড়ে এবং বিশেষ করে মধ্যম আয়ের জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।’
অন্যদিকে কায়রোর বিশ্লেষক শাহিরা আমিন বলেন, বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকট অনেক সময় ‘ধর্মভাব বাড়িয়ে দেয়। বাড়বাড়ন্ত রক্ষণশীলতা প্রায়ই অর্থনৈতিক বঞ্চনার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে চলে।
তাঁর মতে, ‘হতাশা জিহাদি তৈরির জন্য উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে।’