শুল্ক-কর আদায়ে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না এনবিআর। এখন পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের চিত্র ইঙ্গিত দিচ্ছে, বছর শেষে বড় ঘাটতির মুখে পড়তে যাচ্ছে এনবিআর।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) শুল্ক–করসহ সব মিলিয়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ১৬ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। এই সময়ে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। তবে এই সময়ের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৪৮ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। এনবিআরের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এই গতিতে রাজস্ব আদায় হলে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জিত হবে না। এবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুসারে, অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের চাপ আছে। এ ছাড়া হরতাল-অবরোধসহ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতির মুখে পড়তে পারে এনবিআর। গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছিল। এবার ঘাটতি আরও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে আদায়ের জন্য এনবিআরকে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশাল রাজস্ব লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। সেই অনুসারে পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রার ৩১ শতাংশ এখন পর্যন্ত অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। তবে আইএমএফ বলেছে, বছর শেষে অন্তত চার লাখ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় করলেই চলবে।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়ার অন্যতম শর্ত ছিল, প্রতিবছর রাজস্ব আদায়ের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে।
এ বিষয়ে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, রাজস্ব খাতে বড় সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। কেননা, অভ্যন্তরীণ খাত থেকে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কর-জিডিপির অনুপাত সবচেয়ে কম—এমন দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। এই রাজস্ব প্রশাসন দিয়ে একটি বিশাল লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। এবার বড় ঘাটতিতে পড়বে এনবিআর।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আমদানি, ভ্যাট ও আয়কর—এই তিন খাতের মধ্যে কোনোটিতেই পাঁচ মাসের লক্ষ্য পূরণ হয়নি। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি ছিল আয়কর খাতে। আয়কর খাতে ঘাটতির পরিমাণ ৬ হাজার ১১১ কোটি টাকা। জুলাই-নভেম্বর সময়ে আয়কর আদায় হয়েছে ৩৯ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা। এ খাতে লক্ষ্য ছিল ৪৫ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা।
অন্যদিকে এই ৫ মাসে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট খাতে ৫১ হাজার ৫১০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হয়েছে। ভ্যাট খাতে লক্ষ্য ছিল ৫৬ হাজার ৭৫ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের। ফলে এ খাতে ঘাটতি হয়েছে ৪ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা।
এ ছাড়া আমদানি খাতে ৫ মাসে ৫ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। জুলাই-নভেম্বর সময়ে এই খাতের জন্য লক্ষ্য ছিল ৪৭ হাজার ২২২ কোটি টাকা। তবে আদায় হয়েছে ৪১ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা।
এদিকে গত ৩১ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেছেন, বর্তমানে অর্থনীতির গতি কম। এর সঙ্গে নির্বাচনের বছরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রাজস্ব আদায় কর্মকাণ্ডে ইতিমধ্যেই অর্থনীতির শ্লথগতি ও রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তাঁরা বলছেন, অর্থবছরের শেষ দিকে সাধারণত রাজস্ব আদায়ে গতি বাড়ে, ফলে ঘাটতি অনেকটাই পূরণ হয়ে যাবে। তবে নির্বাচনের মৌসুম ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে যদি হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি অব্যাহত থাকে, তাহলে রাজস্ব আদায় আরও পিছিয়ে পড়তে পারে—এমন শঙ্কাও রয়েছে।
প্রথম আলো