এনবিআরের সহজ শিকার

bonikbarta.net

 

আবু তাহের খান

সরকারি চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে আবেদন ফির অপারেটর-কমিশনের অংশের ওপর সম্প্রতি ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এটি আয়হীন অসহায় বেকারদের ওপর অনেকটাই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো। সরকারি চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে বর্তমানে যে হারে ফি আদায় করা হচ্ছে, সেটাকেই সাধারণ মানুষ মাত্রাতিরিক্ত বলে মনে করে। এ অবস্থায় এ ক্ষেত্রে নতুন করে ভ্যাট আরোপ নিঃসন্দেহে অন্যায় ও অন্যায্য এবং সে কারণে স্পষ্টতই এটি একটি রাষ্ট্রীয় অনাচার, তা পরিমাণে সেটি যত সামান্যই হোক না কেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এরূপ একটি অন্যায় ও অন্যায্য পদক্ষেপ তাহলে সরকার গ্রহণ করল কেন?

চাকরিপ্রার্থীদের আবেদন ফির ওপর ভ্যাট আরোপসংক্রান্ত সংবাদের সঙ্গে গণমাধ্যমে এর কারণ সম্পর্কেও খানিকটা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় এবং নানা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে বেড়ে যাওয়ায় সরকারকে বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতিতে পড়তে হয়েছে। এমতাবস্থায় চলতি অর্থবছরেও যাতে সে ধরনের রাজস্ব ঘাটতি সৃষ্টি না হয়, তার আগাম কৌশল হিসেবেই চাকরিপ্রার্থীদের আবেদন ফির ওপর এ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, যা ক্রমান্বয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যয় ক্রমাগতই কেন বাড়ছে, যার জন্য নানা ক্ষেত্রে নতুন করে ভ্যাট ও অন্যান্য কর বসাতে হচ্ছে? বাড়ছে এসব কারণে যে বাংলাদেশ বিমানের গত ১ সেপ্টেম্বরের ঢাকা-নারিতা ফ্লাইটে ৭১ বা তারও বেশিজনকে অতিথি করতে হয়েছে, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে একচেটিয়া মুনাফা লুটের সঙ্গে জড়িত স্বগোত্রীয় বণিকদের ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার শুল্ক অব্যাহতি দিতে হয়েছে। হজের নামে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের শতাধিক জনের লাটবহরকে মাসাধিক কাল ধরে মক্কায় পুষতে হয়েছে এবং এরূপ আরো নানা গর্হিত কাজের পেছনে অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। আর চরম দুর্ভাগ্য ও হতাশার বিষয় এই যে রাষ্ট্রের এ বিপুল রাজস্ব ঘাটতির সময়েও এ ধরনের অন্যায় ও স্বেচ্ছাচারী ব্যয়ের তালিকা প্রতিদিনই আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

এ অবস্থায় হাতের কাছে স্বগোত্রের বাইরে এবং প্রতিবাদে অক্ষম যাকেই পাওয়া যাবে, বাড়তি রাজস্ব আদায়ের জন্য সে-ই যে এনবিআরের সহজ শিকারে পরিণত হবে—এটাই স্বাভাবিক। বেকার চাকরিপ্রার্থীরা এখন সে হিসাব-নিকাশেরই বলি এবং এনবিআরের জন্য তারা এখন খুবই জুতসই গ্রাহক। কারণ এনবিআরের জাল থেকে কৌশলে বেরিয়ে যাওয়ার হাজারটা উপায় বিত্তবান ধূর্ত করদাতাদের জানা থাকলেও চাকরিপ্রার্থীদের জন্য সে সুযোগ একটুও নেই। আর এ প্রসঙ্গে অন্য কয়েকটি নৈতিক প্রশ্নও সামনে চলে আসে। সরকারি দপ্তরগুলোতে জনবল নিয়োগসংক্রান্ত কর্মকাণ্ড সম্পাদনের জন্য সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও প্রার্থীদের কাছ থেকে বিরাট অংকের ফি আদায় করা হচ্ছে কোন যুক্তিতে? যদি ধরেও নেয়া হয় যে ফি নিতেই হবে, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, এ পরিমাণ কি এতটা বেশি হওয়া উচিত? আর তা উচিত নয় বলেই এ ফি কমানোর জন্য চাকরিপ্রার্থীরা বহুদিন ধরেই দাবিদাওয়া জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু সে দাবিদাওয়া পূরণ তো দূরের কথা, উল্টো এখন তাদের ওপর ভ্যাট বসিয়ে দেয়া হলো।

অভিযোগ রয়েছে যে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে বড় অংকের ফি নেয়ার নেপথ্য কারণ হচ্ছে, আদায়কৃত ফি পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সম্মানী ও অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের নামে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেন এবং সে অর্থ থেকে দেদারসে খানাপিনাও করেন। ফলে ফির পরিমাণ বাড়লে ভাগের পরিমাণও স্ফীত হয়। এর বাইরে এখন এনবিআরও হয়তো চিন্তা করবে, এ ফিয়ের হার ও পরিমাণ যত বাড়বে, তাদের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও ততই বাড়বে। কিন্তু জিজ্ঞাসা হচ্ছে, জনবল নিয়োগসংক্রান্ত কাজটি কি সরকারি কর্মচারীদের নিয়মিত কাজের আওতায় পড়ে না? যদি পড়ে, তাহলে সে অর্থ থেকে সম্মানী গ্রহণ ও বিলাসী আহারাদি সম্পন্ন করার সুযোগ কোথায়? প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা, এ দেশের গরিব-দুঃখী সাধারণ মানুষ ও তাদের হতভাগা চাকরিপ্রার্থী বেকারদের আপনারা আর কতটা শোষণ করবেন? একবার ভেবে দেখুন তো, গত ৫২ বছরে চাকরিপ্রার্থী বেকারদের কাছ থেকে রাষ্ট্র কত শত কোটি টাকা আদায় করে এর কর্মচারীরা চাকরি বিধিমালা ও আচরণবিধি ভঙ্গ করে সম্মানী ও ভোগ-বিলাসের নামে কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন?

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তির আবেদন ফি থেকেও এখন লাখ লাখ টাকা আয় হয় এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা তা ভাগযোগ করে নেন। এ নিয়ে নানা কেলেঙ্কারির খবরও মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছে। আর সেসব খবর থেকে এটাও জানা যাচ্ছে যে এ অর্থের ভাগাভাগি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে একধরনের মহোৎসবও হয়ে থাকে! আর তা দেখে মনে হয়, তেল-চিনি-ডিমের সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পার্থক্য খুবই সামান্য। এনবিআর কি বিষয়টির খোঁজ রাখে? রাখলে তাদের কাছে একটি অনুরোধই করব, ওই অসহায় চাকরিপ্রার্থীদের ওপর চড়াও না হয়ে দয়া করে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এ বাবদ যে বিপুল অর্থ আয় করে, তার ওপর কর বসান। তাহলে দুপক্ষই লাভবান হবে। তবে একটি দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এর প্রকৃত সমাধান হচ্ছে বেকারদের কাছ থেকে গৃহীত চাকরির আবেদনপত্রের সঙ্গে কোনো ফি-ই গ্রহণ না করা। আসলে সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা তো রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। সে ক্ষেত্রে একজন বেকারের জন্য কাজের ব্যবস্থা না করে উল্টো তার ওপর ফি ও ভ্যাট আরোপ বস্তুতই সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫ (খ) অনুচ্ছেদ স্পষ্টতই সব নাগরিকের জন্য “কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসংগত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার প্রদান করেছে।

কিন্তু উল্লিখিত সাংবিধানিক অধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাষ্ট্র যখন বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে ও একই সঙ্গে তাদের উৎসবের আমেজে ভাসিয়ে রাখার জন্য নিম্নবিত্তের সাধারণ মানুষের ওপর হায়েনার মতো চেপে বসে, তখন সে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে এরূপ একটি রাষ্ট্রের জন্যই কি আমরা চব্বিশ বছর ধরে সংগ্রাম ও একাত্তরের নয় মাসজুড়ে যুদ্ধ করেছিলাম? চাকরির আবেদন ফির ওপর আরোপিত ভ্যাটের ওই পরিমাণ হয়তো এমন আহামরি অংকের কিছু নয়। কিন্তু এর নৈতিক দিকটি দেখলে এতে হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এ প্রসঙ্গে তাই খুবই সরাসরি জিজ্ঞাসা, যাদের বিত্তের কল্যাণে ২৭৬৫ মার্কিন ডলার (পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ২৮ ডলার কম) মাথাপিছু আয়ের দম্ভ, তাদের কাছ থেকে কি এনবিআর কড়ায়-গণ্ডায় না হোক মোটামুটি হারে হলেও সবটুকু কর আদায় করছে বা করতে পারছে? না, তা তারা করছে না বা করতে পারছে না। মূল কারণ দুটি: এক. এতে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় এবং দুই. রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে ওই বিত্তবানদের করদানে বাধ্য করার ক্ষমতা তাদের নেই। সে তুলনায় চাকরির আবেদন থেকে ভ্যাট আদায় করা অনেক বেশি সহজ ও ঝামেলাবিহীন। অথচ বিত্তবানদের কাছ থেকে প্রাপ্য করের ৫০ শতাংশও যদি ঠিকমতো আদায় করা যেত, তাহলে চাকরির আবেদনের ওপর ভ্যাট আরোপের কোনো প্রযোজনই হতো না।

সামনে নির্বাচন—এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চালাক-চতুর বিত্তবানরা এ সময়ে রাজস্ব ফাঁকির বাড়তি সুবিধা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা যেমনি করবেন, তেমনি আবার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষও হয়তো গায়ে পড়ে তাদের কিছু বাড়তি সুবিধা দেয়ার কথা ভুলবেন না (অতীতের অভিজ্ঞতা অন্তত তাই বলে)। আর এ দুয়ে মিলে সামনের নিকট সময়টুকু ধূর্ত ব্যবসায়ীদের জন্য বেশ ভালো কাটবে বলেই মনে হচ্ছে। তবে মনে রাখা দরকার যে তাদের সময় যত ভালো কাটবে, চাকরিপ্রার্থীদের অনুরূপ সমশ্রেণীর নিম্নবিত্তের জীবন ততই কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ বিত্তবানদের উপার্জন ও মুনাফার লালসা এ সময়ে এতটাই প্রচণ্ড হয়ে উঠবে যে এসবের মূল্য জোগাতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে আরো বেশি হারে কর দিতে হবে, আরো বেশি মূল্যে সেবা ও জিনিসপত্র কিনতে হবে এবং সার্বিক জীবনযাত্রার জন্য আরো বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে। যদিও এ সময়ে তার আয় ও উপার্জন একটুও বাড়বে না।

মোট কথা, চাকরির আবেদনের ওপর ভ্যাট আরোপই নিম্নবিত্তের কষ্ট ও ভোগান্তির সর্বশেষ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ হয়ে থাকবে না। বরং এর সঙ্গে অনুরূপ এবং নতুন মাত্রার আরো নানা নতুন অনুষঙ্গ যোগ হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। আর এজন্য রাষ্ট্রের চরিত্রকেই হয়তো আমরা দায়ী করব। কিন্তু এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর দায়ও কি নেই? ১৯৬০-এর দশকে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মধ্যে সাংগঠনিকভাবে প্রতিবাদী হওয়ার যে চারিত্রিক দৃঢ়তা আমরা দেখেছি, তার ছিটেফোঁটা কোনো অস্তিত্বও শেষোক্ত শ্রেণীদ্বয়ের মধ্যে এখন টিকে আছে? বাঙালির প্রতিবাদী সত্তা কি তাহলে একেবারেই হারিয়ে গেল? না, এখনো হয়তো তা পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। কিন্তু আত্মকেন্দ্রিক মুমূর্ষুতা নিয়ে যেভাবে তা টিকে আছে, সেটিকে কি বাঁচা বলা যায়? চাকরির আবেদনের অপারেটর-কমিশনের অংশের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের ঘটনার নিরুত্তাপ প্রতিক্রিয়া সে মুমূর্ষুতাকেই কি নির্দেশ করছে না?

আবু তাহের খান: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত;

সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়